• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:৪০ পূর্বাহ্ন

ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্ধশতাধিক নারীকে ধর্ষণ করেন ওসি প্রদীপ!

Md. Nazim Uddin / ১৬ ভিউ টাইম
আপডেট : বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২১

জসিম উদ্দীনঃ

মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মাদ রাশেদ হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মাদকের তকমা দিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে শুধু মানুষ হত্যার নেশায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না, টেকনাফের অল্পবয়সী তরুণীদের ইয়াবার তকমা দিয়ে বাড়ি থেকে তুলে এনে থানায় নিয়মিত ধর্ষণের উৎসব করতেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ছাড়াও র‍্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে ওসি প্রদীপের ধর্ষণ-সম্পৃক্ততার এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, প্রদীপ ও তার সহযোগীরা ৫০ জনের বেশি নারীকে ইয়াবা কারবারি বলে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেছেন।

সিনহা হত্যা পরবর্তী টেকনাফে প্রদীপ আমলের কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৬১ জনকে হত্যা ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওইসময় ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা না করায় ধামাচাপা পড়ে প্রদীপের বিরুদ্ধে সিরিয়াল ধর্ষণের অভিযোগগুলো।

টেকনাফ নাজিরপাড়ার ধর্ষণের শিকার এক গৃহবধূ অভিযোগ করে প্রতিবেদককে জানান, স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে ৪৫ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি প্রদীপ। নগদ ৩ লাখ টাকা, ব্যবহারের স্বর্ণালংকার নিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় যান তিনি।

‘স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে তিনদিন আটকে রেখে ওসি প্রদীপসহ কয়েকজন মিলে তাকে টানা ধর্ষণ করেন। তিনদিন পর স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে তাকে বাড়ি চলে যেতে বলা হয়। পরদিন তার স্বামীর গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। ওই সময় ধর্ষণের বিষয়ে মুখ খুললে পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দেন ওসি প্রদীপ।’ -যোগ করেন ওই ভুক্তভোগী নারী।

ওসি প্রদীপের কাছে ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে টেকনাফের হৃীলার আরেক গৃহবধূ জানান, তার স্বামীর কাছে চাঁদা দাবি করে স্থানীয় সন্ত্রাসী গিয়াস বাহিনীর লোকজন। চাঁদা না দেওয়ায় একদিন সন্ধ্যায় এসআই মশিউর বাড়িতে এসে তাকে ইয়াবা কারবারি বলে ধরে নিয়ে যায়। পরে অজ্ঞাত স্থানে টানা তিনদিন আটকে রেখে ওসি প্রদীপ ও সন্ত্রাসীরা তাকে ধর্ষণের পর মরিচের গুঁড়ো দিয়ে গোপন স্থানে পাশবিক নির্যাতন চালায়। এরপর ইয়াবা দিয়ে আদালতে চালান করে দেয়।

ওই নির্যাতিত পরিবারের আলম নামের এক সদস্যের দাবি, তাদের পরিবারের ৬ নারীই প্রদীপের হাতে একইভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

উখিয়া কোর্টবাজারের নির্যাতিতা এক মেয়ের অভিভাবক জানান, ২০১৯ সালের শেষের দিকে তার পরিবারের কলেজ পড়ুয়া ১৭ বছরের এক তরুণী টেকনাফে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গেলে প্রেমিকসহ কয়েকজন মিলে তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেন। ঘটনাক্রমে বিষয়টি ওসি প্রদীপ পর্যন্ত গড়ায়। ওইসময় ধর্ষকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে প্রদীপ নিজেও কয়েক দিন আটকে রেখে একাধিকবার ধর্ষণের পর ইয়াবা দিয়ে ওই মেয়েকে চালান করে দেন।

অভিযোগ আছে, টেকনাফ হোয়াইক্যং এলাকার আনোয়ার নামের এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গিয়ে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি প্রদীপ। টাকা দিতে না পারায় তিনদিন পর কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে তাকে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে প্রতিকার পেতে নিহতের মেয়ে এবং বোন কক্সবাজার আদালতে যান। খবর পেয়ে ওই দুই নারীকে তুলে নিয়ে যায় ওসি প্রদীপের লোকজন। তাদের থানায় আটকে রেখে টানা ৫ দিন গণধর্ষণের পর ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়া হয়।

এদিকে ধামাচাপা পড়ে যাওয়া অসংখ্য নারীর ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করে এই প্রতিবেদক। ভুক্তভোগী নারীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বের করা হয় কক্সবাজার জেলা কারাগারের তৎকালীন মেডিকেল রাইটার হাজতি মো. ইউসুফকে। তিনি কারাগারে থাকাকালীন প্রদীপের কাছে ধর্ষিত অসংখ্য নারীকে চিকিৎসা দিয়েছেন বলে তথ্য দিয়েছেন।

ইউসুফ জানান, ঘটনাক্রমে একটি মিথ্যা মামলায় ফেঁসে গিয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট ও চিকিৎসার বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকায় তাকে কারা মেডিকেলের রাইটার হিসেবে দায়িত্ব দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সেই সুবাদে কারাগারে থাকা সব রোগীদের তিনি দেখভাল করতেন।

ইউসুফ জানান, টেকনাফের ১৬ বছরের এক তরুণী তাকে জানিয়েছিলেন বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে তাকে থানায় ১৫ দিন আটকে রাখেন ওসি প্রদীপ। এসময়ের মধ্যে একাধিকবার প্রদীপ তাকে ধর্ষণ করেন। পরে একইভাবে আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যও তাকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পর প্রত্যেকবার গোপনাঙ্গে মরিচের গুঁড়ো দিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয় তাকে। এসময় যন্ত্রণায় চিৎকার করলে প্রদীপ ও তার সহযোগীরা উল্লাসিত হতেন বলে জানান ওই তরুণী। ধর্ষণ-পরবর্তীতে তাকে ইয়াবা দিয়ে চালান করে দেওয়া হয়েছিল।

কারাগারে এসে অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন ওই তরুণী। পরবর্তীতে সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তার বুকে-পিঠে অমানসিক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল বলে জানান ইউসুফ।

একইভাবে কারাগারে আসা টেকনাফের রঙ্গিখালীর এক তরুণী ইউসুফকে জানিয়েছিলেন, বাড়ি থেকে তুলে এনে একমাসের বেশি সময় আটকে রেখে একাধিকবার ধর্ষণ করেন ওসি প্রদীপ। পরে মরিচের গুঁড়ো দিয়ে তাকেও মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়। সর্বশেষ ইয়াবা দিয়ে তাকেও চালান করে দেওয়ার ভয়াবহ বর্ণনা ওই তরুণীর মুখে শুনেছেন ইউসুফ।

এভাবে কারাগারে আসা অগণিত নারী চিকিৎসা নিতে এসে প্রদীপের কাছে ধর্ষণের লোহমর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইউসুফ।

ইউসুফের দেওয়া তথ্যমতে, প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণী প্রদীপ কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন জানিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। অবস্থা জটিল হলে ধর্ষিতাদের পাঠানো হত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে তাদের চিকিৎসা। এর বাইরেও অনেকে গর্ভবতী না হওয়ার জন্য চিকিৎসা নিলেও লজ্জায় ধর্ষণের কথা স্বীকার করেননি।

ইউসুফ আরও জানান, কারাগারে অন্তত ১৭ জন ধর্ষিতার লোমহর্ষক বর্ণনা এখনো তিনি ভুলতে পারেন না। তারা সবাই প্রদীপের ধর্ষণ-পাশবিকতার শিকার বলে দাবি করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রদীপ আমলে বাড়ি থেকে যেসব মেয়েদের টেকনাফ থানা পুলিশ ধরে আনতো তাদেরকে কমপক্ষে তিন থেকে ১০ দিন, কখনো এক মাস পর্যন্ত থানায় বা অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হতো। এসময়ের মধ্যে অভিভাবকদের কোনও ধরনের দেখা-সাক্ষাত বা তথ্য দেওয়া হতো না। বরং এ বিষয়ে কাউকে জানালে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হতো।

এদিকে প্রদীপের সিরিয়াল ধর্ষণের বিষয়ে অবগত ছিলেন টেকনাফের স্থানীয় সাংবাদিকরাও। ওসি প্রদীপ টেকনাফের সুন্দরী মেয়েদের ইয়াবা কারবারি দাবি করে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে টানা কয়েকদিন আটকে রেখে ধর্ষণের পর ইয়াবা দিয়ে চালান করে দিতেন বলে জানান সাংবাদিকরা। তবে প্রাণের ভয়ে নীরব ছিলেন বলে দাবি তাদের।

স্থানীয় সংবাদকর্মী রহমত উল্লাহ জানান, টেকনাফের রঙ্গিখালীর মেয়েরাই প্রদীপের পাশবিকতার শিকার হয়েছেন বেশি। ওই এলাকার মেয়েরা একটু সুন্দরী এবং ভীতু বলে পরিচিত।

কক্সবাজারের সিনিয়র আইনজীবী আবদুল মান্নান বলেন, আমি শুনেছি, প্রদীপ কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়ে ৫ থেকে ৬ জন নারী প্রেগনেট অবস্থায় বর্তমানে কারাগারে অবস্থান করছেন। নির্যাতিতা পরিবার থেকে আমি এসব শুনেছি। বিষয়টি তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে। এ আইনজীবীর মতে, ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে মামলা না করলেও রাষ্ট্র চাইলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী বলেন, আমি ওসি প্রদীপের পাশবিকতার শিকার প্রায় নারীর ঘরে গিয়েছি। টেকনাফের অগণিত মেয়ে আমাকে জানিয়েছেন তারা প্রদীপের মাধ্যমে কীভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, এক পরিবারের দুই বোনকে থানায় তুলে নিয়ে ১৫ দিন আটকে রেখে একাধিকবার ধর্ষণ করেছেন এমন অভিযোগও পেয়েছি। তবে নির্যাতিত এসব পরিবারগুলো প্রদীপের শাস্তির দাবি জানালেও ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ হওয়া ও লোকলজ্জায় মামলা করতে আগ্রহী নয় বলে জানান তিনি। কাবেরী এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও স্বপ্রণোদিত মামলা করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

এদিকে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা র‍্যাবের তদন্তেও অসংখ্য নারীকে থানায় তুলে এনে ওসি প্রদীপের ধর্ষণ সংক্রান্ত ঘটনার সত্যতা মিলেছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসপি খায়রুল ইসলাম বলেন, আমরাও অনেক নারীর কাছ থেকে ওসি প্রদীপের থানায় ধরে এনে শ্লীলতাহানির অভিযোগ পেয়েছি। এসব বিষয় অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালত চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

তিনি বলেন, ধর্ষণের বিষয়ে আলাদাভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। নির্যাতিত পরিবারগুলো মামলা করলে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।

এদিকে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর শঙ্কা, ধর্ষণের বিষয়ে মামলা করলে তাদের উল্টো হয়রানির মুখে পড়তে হতে পারে। একদিকে ধর্ষিতার পরিচয় প্রকাশ হলে সমাজে পুরো পরিবারই হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে মামলা করলেও প্রদীপসহ জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা নিয়ে শঙ্কা তাদের। এ কারণে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও স্বপ্রণোদিত মামলা করে জড়িতদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বলছে, মামলা না করলেও নাগরিক হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত রাষ্ট্রের। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, ধর্ষণের বিষযটি যদি সত্য হয়ে থাকে এর বিচার না হলে দেশের আইনি ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো যদি মামলা নাও করে নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ধর্ষণে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সেক্রেটারি জেনারেল মো. নূর খান লিটন বলেন, ধর্ষণের অভিযোগ সত্য হলে এ বিষয়ে কাজ করবো। আইন রক্ষাকারী কর্মকর্তার কাছে এভাবে সাধারণ নারীরা ধর্ষিত হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

বিষয়টি পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর নজরে আনা হলে দুইজনই এ ধরনের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকলে ভুক্তভোগীদের মামলা করার পরামর্শ দেন।

সূত্র: একুশে পত্রিকা


আরো বিভন্ন বিভাগের নিউজ