• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন

ইয়াবা কুইন রোজিনার হাতেই কুপোকাত পুলিশ!

Md. Nazim Uddin / ১৯ ভিউ টাইম
আপডেট : রবিবার, ৭ মার্চ, ২০২১

কক্সবাজার শহরের ১নং ওয়ার্ডের ফদনার ডেইল এলাকার আলোচিত নারী রোজিনা আক্তার। কক্সবাজারের সর্বত্রই ‘ইয়াবা কুইন রোজিনা’ হিসেবে এক নামে পরিচিত। পুলিশ পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা ছিনতাইয়ের শিকার সেই রোজিনা ভয়ঙ্কর মাদক কারবারি; ইয়াবা লেনদেনের অডিও রেকর্ড ভাইরাল হয়েছে। রয়েছে ২০ সদস্যের রোহিঙ্গা নারী সিন্ডিকেট: আতঙ্কের নাম রোজিনার বিরুদ্ধে ইয়াবার লিখিত অভিযোগ; তিনটি মারামারি মামলায় দুইবার কারাগারেও যান: কোটি টাকা বনে যাওয়ায় সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকেও আবেদন।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের নাম ভাঙিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে চলছে রোজিনার ইয়াবার হাট। এ ছাড়াও রোজিনার সহযোগিতায় কতিপয় পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার বাণিজ্যে লিপ্ত। পরে মধ্যস্থতা করেন রোজিনা নিজেই। রোজিনার ইয়াবা লেনদেনের কয়েকটি ফোন আলাপ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

“রোজিনা আন্টির ওখানে গিয়ে সমিতি পাড়ার গলির ভিতরে জিনিস (ইয়াবা) গুলো দিবা, ওনি আমাকে পথ দেখায় দেয়, হা ওটা ওনার বোনের বাড়ি, তোমার বোনকে কি পাঠিয়েছিলে ওনার সাথে, আমার বোনকে একা পাঠিয়েছিল, কারণ ওনি একা ভয় পাচ্ছে তাই সমিতি পাড়া রানী ফামের্সীর ওখানে যায়, অ হ্যালো নুর বেগম আপা এরে (ওখানে) জিনিস (ইয়াবা) কত ৭০০শ নাকি ১০০০ হাজার ছৌ-ত, ১০০০ হাজার আপা ১০০০ হাজার, মিনাবি নিজের হাতে গনি লয়ে য়াই ন-ধরি, রোজিনা কোরআন শরিফ দরি হইত পারিবিনি? নুর বেগম য়াই কোরয়ান শরিফ ধরি হইত পাইজ্জম আপা য়াই চাইতাক্কি য়াই ন-ধরি মানুষ ওনে মিনাবিরে দিয়ে মিনাবি নিজের হাতে গনি লয়ে, এরে ভাঙা তিন্গা মিনাবি লয়ে, ১২ ওয়ারমত হম আছে। রোজিনা এ-এ ঠিক আছে ইবার হতা। আচ্ছা আপা তুমি রাতে বাসায় আসো কথা হবে।” দুইজনের কথোপকথনের এমন একটি অডিও রেকর্ড এখন ভাইরাল। তারা দুইজন হলেন, কক্সবাজার ১নং ওয়ার্ড কুতুবদিয়া পাড়া এলাকার রোজিনা আক্তার ও নুর বেগম। তাদের দুজনের কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড ভাইরাল কয়েকদিন ধরে।

আরেকটি অডিও রেকর্ডে রোজিনা বলেন, “আমাকে ধরতে হলে আগে আমার পিছনে ১০০ জনকে ধরতে হবে, আমি যেমন তারাও তেমন, সবার আগে গডফাদার ধরতে হবে, আমিত চামিচ (ছোট)।” মাছন নামের একব্যক্তির সাথে রোজিনা আক্তারের এমন কথোপকথনও এখন ভাইরাল হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে রোজিনা আক্তারের বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার জনশ্রুতি থাকলেও কয়েকদিন ধরে ফের আলোচনায় আসে রোজিনা। গত সোমবার বিকালে রোজিনা আক্তারের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তিন লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় কক্সবাজার সদর থানার তিন পুলিশ সদস্য। তাদের বরখাস্তও করা হয়েছে। বর্তমানে এই তিন সদস্যের রিমান্ডও চলছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটিও। কক্সবাজার শহরের ১নং ওয়ার্ড কুতুবদিয়া পাড়া এলাকায় রোজিনার বাড়িতে এই ঘটনা ঘটে। রোজিনা ওই এলাকার রিয়াজ আহমেদ ওরফে ইলিয়াছের স্ত্রী এবং মৃত নুর কবিরের মেয়ে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রোজিনার ইয়াবা ব্যবসার তথ্য ও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে উল্টো হয়রানি শিকার হয়েছেন অনেকেই। এ কারণে নিজ এলাকায় বেশিরভাগ মানুষের কাছে মূর্তিমান আতংক এ গৃহবধূ। রোজিনার নারী-পুরুষ মিলে ১৫-থেকে ২০ সদস্যদের একটি চক্র রয়েছে। যারা ইয়াবার চালান বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দেন।

জানা গেছে, ইয়াবা ব্যবসাসহ নানা অভিযোগ উল্লেখ করে রোজিনার বিরুদ্ধে ওই এলাকার সমাজ কমিটিসহ অনেকেই প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়ার পরও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

গত ১ মার্চ সেই রোজিনাকে অস্ত্র ঠেকিয়ে তিন লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ির উপ পরিদর্শক (এসআই) নুর ই খোদা সিদ্দিকী, কনস্টেবল আমিনুল মুমিন এবং মামুন মোল্লাসহ তিনজন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেফতার পুলিশ সদস্যরা এখন রিমান্ডে রয়েছে।

এ ঘটনার পর সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্য। কক্সবাজারের সর্বত্রই সাধারণ মানুষের বলাবলি করছে পুলিশের ‘সৃষ্টি ‘ইয়াবা কুইন রোজিনার হাতেই কুপোকাত পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিব্রত।

কক্সবাজার পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান প্রতিবেদককে বলেন, রোজিনার অভিযোগের ভিক্তিতে তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও রুজু হয়েছে। এখন তারা দ্বিতীয় দফায় ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছে।

স্থানীয়দের দাবি, মাদক কারবারিদের ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারের পর অসৎ কিছু পুলিশ সদস্য কিছু ইয়াবা সরিয়ে ফেলে। ইয়াবাগুলো রোজিনার মাধ্যমে বিক্রি করান এমন প্রচার রয়েছে এলাকায়। এ কারণে রোজিনার কথামতো পুলিশ প্রায় সময় ধরে নিয়ে যান, আবার টাকার বিনিময় ছেড়েও দেন। এভাবে পুলিশই রোজিনাকে সৃষ্টি করেছে।

সাম্প্রতিক ঘটনা ও রোজিনার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত এমন একটি সূত্রের দাবি, ঘটনার দুইদিন আগে রোজিনার চক্রের একজন সদস্যকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে ছাড়াতে রোজিনার সাথে পুলিশের মোটা অংকের দফারফা হয়। সে অনুযায়ী পুলিশ ওই মাদক কারবারিকে ছেড়ে দিলেও দাবিকৃত সব টাকা পরিশোধ করেনি রোজিনা।

ঘটনার দুইদিন পর গত ১ মার্চ রোজিনার বাড়িতে ইয়াবার চালান বিক্রির নগদ টাকা মজুদ আছে এমন খবরের ভিত্তিতে কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) নুর ই খোদা সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সাদা পোশাকের তিন পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় দুইজন সোর্স রোজিনার বাড়িতে হানা দেয়। এসময় বাড়ি তল্লাশি করে ইয়াবা না পেলেও মাদক বিক্রির তিন লাখ টাকা রোজিনার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনিয়ে নেয়।

তবে রোজিনার দাবি, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই তার বাড়িতে ঢুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে ৩ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় পুলিশ। পরে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে সাদা পোশাক পরিহিত পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যায়। এসময় একজনকে ধরে ফেলেন। পরে ৯৯৯ কল দিয়ে পুলিশের সহযোগিতা নেন। রোজিনা তার বিরুদ্ধে উঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

এদিকে রোজিনার ইয়াবার লেনদেনের একাধিক ফোন আলাপ প্রতিবেদকের কাছে এসেছে, একটি অডিওতে রোজিনাকে ইয়াবার চালান পৌঁছে দেওয়ার তথ্য দিচ্ছেন এক মহিলা।

আরেকটি অডিওতে এক ব্যক্তিকে রোজিনা বলেছেন, “আমাকে ধরতে হলে আগে আমার পিছনে ১০০ জনকে ধরতে হবে, আমি যেমন তারাও তেমন, সবার আগে গডফাদার ধরতে হবে, আমি তো চামিচ (ছোট)।

জানতে চাইলে রোজিনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে অডিও রেকর্ড সম্পর্কে বলেন, আমি এলাকার বিভিন্ন বিচার করি। একটি বিচার নিয়ে এক মহিলার সাথে মোবাইলে কথা হয়। যা রেকর্ড শুনেছেন তা ইয়াবার বিষয় নয়। বিচারের বিষয় ছিল। গডফাদারের বিষয়ে রোজিনা বলেন, আমার এলাকার মাছন নামে এক ব্যক্তির সাথে আমার পরিচয়। তার সাথে মোবাইলে কথা বলার সময় দুষ্টুমির ফাঁকে গডফাদারের কথা বলা হয়েছে। সে আমার সাথে দুষ্টুমি করে কৌশলে রেকর্ড নিয়েছে।

পুলিশের নাম ভাঙিয়ে রোজিনার ইয়াবার হাট, তথ্য দিলে উল্টো হয়রানিসহ নানান অভিযোগের তথ্য অবগত করে জানতে চাইলে কক্সবাজার পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান প্রতিবেদককে বলেন, যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠেছে তারা রিমান্ডে রয়েছে। এছাড়া আলাদাভাবেও একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তারাও এ বিষয়ে কাজ করছে।

পুলিশের ‘সৃষ্টি’ রোজনার হাতেই পুলিশ কুপোকাত কিনা এমন প্রশ্নে পুলিশ সুপার বলেন, কয়েকজন পুলিশের অপরাধের দায়ভার একটি বাহিনী নিবে না। আর মহিলাটির বিষয়ে অনেক অভিযোগ ও তথ্য আমরা পাচ্ছি তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মাদক বা কোনো অপরাধের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।


আরো বিভন্ন বিভাগের নিউজ