• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:০৫ পূর্বাহ্ন

শহরের পাহাড়ের পাদদেশে লাখো মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস

চ্যানেল কক্স আপনার পাশে / ২৮ ভিউ টাইম
আপডেট : মঙ্গলবার, ১ জুন, ২০২১

মোঃ নূরুল হোসাইন:

কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে লাখো মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। তাদের সরাতে নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে ঘটছে দর্ঘটনা হচ্ছে প্রাণহানী।

শহরের সরকারী ছোট বড় শতাধিক পাহাড় গেল এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কয়েকটি প্রভাবশালী চক্র দখল করে ছোট ছোট প্লট আকারে স্টাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করে দিয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তু হওয়া নিম্ন আয়ের দিনমজুর ও রোহিঙ্গাদের কাছে। সে সব মানুষ গুলো পাহাড় ও গাছপালা ধ্বংস করে বসতি স্থাপন করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে তারা। যে সব চক্র শহরের সরকারী পাহাড় বিক্রি করে হাতিয়ে নিলো কোটি কোটি টাকা তাদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা হলেও অদ্যবদি কোন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি সরকারী সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। এতে করে বেড়েছে ভূমিদস্যু চক্রের দৌরাত্ম, গ্রাস করে ফেলেছে শহরের সরকারী বড় বড় পাহাড় বেদখল হয়ে গেছে শত শত একর পাহাড়ি ভূমি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শহরের পাহাড়তলী, হালিমাপাড়া, হেলালীঘোনা, সাত্তারঘোনা, বাঁচা মিয়ার ঘোনা, বখতিয়ারঘোনা, আবু উকিলের ঘোনা, বৈদ্যঘোনা, বাদশাঘোনা, ঘোনারপাড়া, সৈকতপাড়া, লাইট হাউজ পাড়া, লারপাড়া, বিজিবি ক্যাম্প, সিটি কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ী এলাকা, দক্ষিণ রুমালিয়ার ছড়া ও কলাতলীর বাদশারঘোনা, চন্দ্রিমার ঘোনা, ঝিরঝিরি পাড়ায় শতাধিক পাহাড়ের অন্তত ৫ শতাধিক পরিবারের কয়েক লক্ষ মানুষ বসবাস করছে। তারা এসব পাহাড় বছর বছর কেটে ঘর তৈরি করার কারনে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে অন্তত ৫০টিরও বেশি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে প্রবল বর্ষনে পাহাড়ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।

এলাকা ঘুরে পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা বেশীরভাগ নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ। এসব মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসাবে শতক প্রতি ৩০–৫০ হাজার টাকা আবার কোন কোন স্থানে ৮০–১ লক্ষ টাকায় দখলদারের কাছ থেকে স্টাম্পের মাধ্যমে চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ক্রয় করে কোন মতে ঘর তৈরি করে বসবাস করছে।

এতো ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করার কারন জানতে চাইলে পাহাড়তলী হেলালী ঘোনার (বাজারঘাটার রড সিমেন্ট দোকানের কুলি) আব্দুল গণি (৫৫) বলেন, আমরা কেটে খাওয়া মানুষ, দিন মজুরী করে ৭ সদস্যের পরিবারের ভরনপোষণ দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে পারি না। এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ৫ বছর আগে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ২ শতক পাহাড়ি জমি কিনে কোন মতে টিন দিয়ে ঘর তৈরি করে বসবাস করছি। এছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। একই কথা বলেছেন বাঁচামিয়ার ঘোনার আব্দুল হালিম(৪৫), বাদশাঘোনা এলাকার মৌলভী হাফেজ আলম (৪২), পাহাড়তলী ইসলামপুরের মোঃ আমিন (৪০), বৈদ্যঘোনার ইলেক্ট্রিক মেস্ত্রী মোঃ হোসেন (৪০), কলাতলী চন্দ্রিমারঘোনার বিধবা খায়রুন্নাহার (৬০) ও বাদশার ঘোনার হোসনে আরা বেগম (৪৫)। তারা আরও বলেন, সরকার যদি আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করলে আমরা এসব পাহাড় ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছি।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’স কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক রাশেদুল মজিদ বলেন, শহরের আদর্শগ্রাম, কলাতলী, সিটি কলেজ এলাকা, পাহাড়তলী, ঘোনার পাড়া, খাঁজামঞ্জিল ও বৈদ্যঘোনাসহ বিভিন্ন এলাকার ২০টির বেশি স্থানে পাহাড়ে বসবাসকারী দেড় লাখের বেশি মানুষ চরম ঝুঁকিতে আছে৷ আসন্ন বর্ষা মৌসুমে প্রবল ভারী বর্ষণ হলে পাহাড়ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। গত ৫-৭ বছরে শহরে ১৫ টির বেশি পাহাড়ধসের ঘটনায় কমপক্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

গতকাল সোমবার সকালে বৈদ্যঘোনা, পাহাড়তলী ও বাঁচামিয়ারঘোনা’র পাহাড়ী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষ উঁচু পাহাড় কেটে কাঁচা ঘরবাড়ি তৈরি করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে৷ একটু বৃষ্টি হলে এসব পাহাড়ি রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যায় এতে নারী-শিশুরা গৃহবন্দী হয়ে পড়ে।

স্থানীয় এক গৃহবধূ মনিরা বেগম বলেন, প্রতিদিন দেড়’শ ফিট নিচে গিয়ে নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু বৃষ্টি হলে পানি আনা সম্ভব হয় না। বৃষ্টির কারণে পাহাড় থেকে নিচে নামার রাস্তাটি পিচ্ছিল ও কাঁদাযুক্ত হয়ে যায়।

স্থানীয় দিনমজুর সাইফুল ইসলাম বলেন, গত দুই বছর আগে বর্ষাকালে প্রবল বর্ষণে তাঁর বসতবাড়ি ধসে পড়েছিল। এতে তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ের হাত-পা ভেঙে যায়। এবারও বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃৃষ্টিপাত হলে বসতবাড়ি ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে৷ কিন্তু ঘর তৈরির বিকল্প জমি নেই বলে পাহাড় থেকে নামা সম্ভব হচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ-সহকারী পরিচালক সংযুক্তি দাশ গুপ্তা বলেন, পাহাড় কাটা বন্ধ ও বসতি উচ্ছেদের জন্য গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অন্তত ২০টি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় শতাধিক নতুন করে তৈরি ঘরবাড়ি উচ্ছেদ ও পাহাড় কাটার দায়ে মামলা এবং জরিমানা করা হলেও আরও বহু অবৈধ স্থাপনা রয়ে গেছে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদে যৌথ অভিযান দরকার। কিন্তু আমাদের লোকবল সংকটের কারনে একসাথে এত অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, বৃষ্টি হলে পাহাড় কাটার কারনে মাটি নরম হয়ে ধসে পড়ে। যদি বর্ষাকালে টানা বর্ষণ হয় তা হলে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীর পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিবে।

পৌরসভার প্যানেল মেয়র (২) কাউন্সিলর হেলাল উদ্দিন কবির বলেন, দেশের জলবায়ু উদ্বাস্তু দেড় লাখ মানুষের পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন পাহাড়ে বর্তমানে বসবাস করছে আরও অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি তৈরির জন্য প্রতিদিন পাহাড় নিধন করছে। অনেকে বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে পাহাড় কাটে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে শহরের নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে যায়। ফলে পুরো শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। পাহাড় কাটা রোধে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী বলে মনে করেন তিনি।

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবর রহমান বলেন, বর্ষাকাল এলেই পাহাড়ে বসবাসকারী লাখো মানুষকে নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। পাহাড়ধসে প্রতিবছর বহু মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু মাথা গোঁজার বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়ায় পাহাড় থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনা যাচ্ছে না।


আরো বিভন্ন বিভাগের নিউজ