• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৪ পূর্বাহ্ন

ডায়াগনসিস (টেস্ট)-এর ফাঁদে অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা!

নিউজ রুম / ১৬৩ ভিউ টাইম
আপডেট : বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৯

-রাজিব আহমেদ

ধরা যাক, দু’দিনেও জ্বর ভালো না হওয়ায় আপনি ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার সাহেব আপনাকে শুরুতেই তিনটি পরীক্ষা (টেস্ট) দেবেন। টেস্ট রিপোর্ট-এ জ্বরের কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও কোলেস্টেরল আর ব্লাড সুগার লেভেল একটু বেশি পাওয়া যাবে! এখন আপনি আর জ্বরের রোগী নন, ডাক্তারের কথায় আপনিও বিশ্বাস করবেন- আপনার কোলেস্টেরল বেশি আর প্যারা-ডায়বেটিস হয়ে আছে। আপনাকে এখন থেকে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খেতে হবে, সঙ্গে অনেকগুলো খাবারে নিষেধাজ্ঞা।

আপনি খাবারের নিষেধাজ্ঞা ঠিকঠাক না মানলেও ওষুধ খেতে ভুল করবেন না। এভাবে তিন মাস যাওয়ার পর আবার টেস্ট। এবারে দেখা যাবে কোলেস্টেরল-এর মাত্রা কিছুটা কমেছে, কিন্তু রক্তচাপ বেড়ে গেছে- যেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে আরেকটি ওষুধ লাগবে। এদিকে কখন কী হয়ে যায়; এখনো তো কোনোকিছুই গোছানো হয়নি- এমন দুশ্চিন্তায় আপনার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ফলে ডাক্তারের পরামর্শে অথবা নিজের বুদ্ধিতে ঘুমের ওষুধ খাওয়া শুরু করে দেবেন! ওদিকে একসঙ্গে এতোগুলো ওষুধ খাওয়ামাত্রই বুক জ্বালাপোড়া করে বিধায় প্রতিবেলা খাওয়ার আগে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে নিতে হবে। মাঝে মধ্যে সোডিয়াম কমে যায়, সেজন্যও আছে সাপ্লিমেন্ট!

এভাবে বছরখানেক যাওয়ার পর আপনি বুকে ব্যাথা অনুভব করায় হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ছুটে গেলেন। ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলবেন, সময়মতো আসায় এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন, আরেকটু দেরি করলেই সর্বনাশ হয়ে যেত! তারপর আরো কিছু বিশেষায়িত পরীক্ষা করে বলা হবে, আপনি যে ওষুধগুলো খাচ্ছেন, ওভাবেই চলবে, সঙ্গে হার্ট-এর জন্য আরো দু’টো ওষুধ খেতে হবে আর অবিলম্বে একজন হরমোন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করুন। সেখানে যাওয়ার পরে যোগ হবে ডায়বেটিস-এর ওষুধ!

এভাবে আরো ছয় মাস চলার পর প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দেবে। রুটিন চেক-আপ করতে গিয়ে জানতে পারবেন- আপনার কিডনিতে সামান্য সমস্যা আছে; ক্রিটিনিন একটু বেশি, নিয়মিত ওষুধ খেলে আর কোনো চিন্তা নেই। ফলে মোট ওষুধের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো দশ-এ।

আপনি এখন খাবারের চেয়ে ওষুধ বেশি খান আর নানারকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় খুব দ্রুত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন! অথচ যে জ্বরের জন্য আপনি সর্বপ্রথম ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন, তিনি যদি বলতেন, তেল আর চিনি খাওয়া বাদ দিন, পর্যাপ্ত পানি পান করুন, কার্বোহাইড্রেড কমিয়ে টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল বেশি করে খান আর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে হাঁটাহাটি করুন. তাহলেই আপনার শরীর ফিট হয়ে যেত। কোনোপ্রকার ওষুধের প্রয়োজনই হতো না। কিন্তু সেটা করলে ডাক্তার সাহেব আর ওষুধ কোম্পানিগুলোর পেট ভরবে কিভাবে? তারচেয়েও বড় প্রশ্ন হলো- কিসের ভিত্তিতে ডাক্তারগণ আপনাকে কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, কিডনি বিকল আর হৃদরোগী ঘোষণা করছেন, কী সেই মানদন্ড- যা কিনা বিনা চ্যালেঞ্জ-এ সমগ্র বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চর্চিত হয়ে আসছে আর সেটি নির্ধারণ করলেন কে বা কারা?!?

প্রথমেই ডায়বেটিস। ১৯৭৯ সালে রক্তে শর্করার মাত্রা 200ml/dl দেখালে ডায়বেটিস হিসেবে গণ্য করা হতো। সেই হিসেবে তখন সমগ্র পৃথিবীর মাত্র ৩.৫% মানুষ টাইপ-২ ডায়বেটিস-এ আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। তারপর ১৯৯৭ সালে ইনসুলিন প্রস্তুতকারকদের চাপে সেই মাত্রা এক লাফে কমিয়ে 126ml/dl করা হয়। ফলে ডায়বেটিস রোগীর সংখ্যা ৩.৫% থেকে এক লাফে বেড়ে ৮% হয়ে যায় অর্থাৎ রোগের কোনোরূপ বহিঃপ্রকাশ ছাড়াই স্রেফ ব্যবসায়িক স্বার্থে ৪.৫% মানুষকে রোগী বানিয়ে ফেলা হলো! ১৯৯৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই মানদন্ডে সায় দেয়। ওদিকে ফুলে-ফেঁপে ওঠা ইনসুলিন প্রস্তুতকারকেরা অঢেল মুনাফা বিনিয়োগ করে সারাবিশ্বে নিত্য-নতুন প্ল্যান্ট বসাতে থাকে। তাদের চাপে নতি স্বীকার করে American Diabetes Association (ADA) ২০০৩ সালে রক্তে শর্করার মাত্রা 100ml/dl-কে ডায়বেটিস রোগের মানদন্ড হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দেয়। ফলে কোনো কারণ ছাড়াই ২৭% মানুষ ডায়বেটিস রোগী হয়ে যায়!

বর্তমানে American Diabetes Association (ADA) কর্তৃক ঘোষিত মানদন্ড >140mg/dl (P.P) or >100mg/dl (Fasting) or >HbA1C>5.6% হিসেবে বিশ্বের ৫০.১% মানুষকে কৌশলে ডায়বেটিস রোগী বানিয়ে ফেলা হয়েছে! এদের অধিকাংশ ডায়বেটিস রোগী না হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত ওষুধ খেয়ে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে মারা যাচ্ছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, টেস্ট করালেই যে কোনো মানুষ প্রি-ডায়বেটিস রোগী হিসেবে গণ্য হবেন!

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক কনভেনশনে সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রচলিত ওষুধ দিয়ে ৪৮টি রোগের চিরস্থায়ী নিরাময় সম্ভব নয়; সেই তালিকায় ডায়বেটিসও রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো ডায়বেটিস-এর মানদন্ড হিসেবে রক্তে শর্করার মাত্রা ৬.৫%-৭% থেকে ৫.৫%-এ নামিয়ে আনার জন্য তাদের এজেন্ট/প্রতিনিধিদের দ্বারা অবিরাম ডাক্তারদের মগজ ধোলাই করে চলেছেন এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছেন। পরিণামে আর কিছু হোক বা না হোক বাংলাদেশে ডায়বেটিসের ওষুধ বিক্রিতে মাত্রাতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি সুনিশ্চিত হয়েছে। যদিও অনেক প্রাকৃতিক চিকিৎসক মনে করেন- রক্তে শর্করার মাত্রা সর্বোচ্চ ১১% পর্যন্ত ডায়বেটিস হিসেবে গণ্য করা যায় না।

প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০১২ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট বিশ্ববিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি Glaxo Smith Kline (GSK)-কে তিন বিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, তারা ডায়বেটিস রোগীদের জন্য যে ওষুধ বাজারজাত করছে, তা খেয়ে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যুহার ৪৩% বেড়ে গেছে! পরে জানা যায়, GSK কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি আগে থেকেই জানত এবং তাদের ট্রায়াল থেকেও একই রিপোর্ট এসেছিল। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে তারা মুনাফা অর্জনকে প্রাধান্য দিয়েছিল, মানুষের প্রাণের কোনো মূল্য তাদের বিবেচনায় ছিল না। ফলে ওই সময়ে তারা প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মুনাফা করে এবং অকাল মৃতদের পরিবারকে মাত্র তিন বিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দিয়ে পার পেয়ে যায়!

এবারে কোলেস্টেরল প্রসঙ্গ। ১৯৭৭ সালে কোলেস্টেরল-এর মানদন্ড নির্ধারিত হয় ৩০০। এর নিচে থাকলে যে কোনো মানুষ সুস্থ ও স্বাভাবিক (তখনো LDL, HDL ও TG বিষয়টি আলাদাভাবে গুরুত্ব পায়নি)। ফলে মাত্র ১০% মানুষের দেহে উচ্চ কোলেস্টেরল আছে বলে প্রতীয়মান হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির পরিচালক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে Adult Treatment Plan (ATP) নামে একটি গ্রুপ তৈরি হয়, যারা নির্ধারণ করবে কোলেস্টেরল-এর মাত্রা কত হলে রোগ হিসেবে গণ্য করা হবে। ১৯৮৮ সালে ATP গ্রুপ কোলেস্টেরল-এর মাত্রা নির্ধারণ করে ২৫০ থেকে ৩৫০। অর্থাৎ কৌশলে মানদন্ড আরো ৫০ নামিয়ে ফেলা হলো। পরিণামে আরো ১০% কথিত রোগী এই ফাঁদে ধরা পড়ল। এরপর জাপানি গবেষক আকিরা এন্ডো আর মার্কিন গবেষক ব্রাউন ও গোল্ডস্মি’র গবেষণালব্ধ তত্ত্ব সামনে এনে বলা হলো, কোলেস্টেরল কোনো একক জিনিস নয়, এর বিভিন্ন ধরন আছে। তখন LDL বিষয়টি সামনে এনে ঘোষণা করা হয় যে, সুস্থতার মানদন্ড হচ্ছে ২৪০ এবং LDL খারাপ কিছু। ফলে রোগীর সংখ্যা আরো ২০% বেড়ে গেল।

১৯৯৩ সালে ATP2 ঘোষণা করে- LDL ছাড়াও আরো এক ধরনের কোলেস্টেরল আছে, যার নাম HDL; অর্থাৎ সুস্থতার মানদন্ড হচ্ছে ২৪০+LDL+HDL। ফলে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৩৭%-এ। সবশেষে ২০০৩ সালে ATP3 ঘোষণা করে : সুস্থতার মানদন্ড হচ্ছে ২৪০+LDL+HDL+TG। ফলে রোগীর সংখ্যা হয়ে গেল ৪৮%, যা এখনো বলবৎ আছে। শুধুমাত্র ওষুধ কোম্পানির ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ৪৮% মানুষকে কোলেস্টেরল-এর রোগী বানানো হয়েছে! দেশের মেধাবী ছাত্রদেরকে ডাক্তার বানানো হলেও কেউ এসবের প্রতিবাদ করা দূরে থাক, বরং ডাক্তার হয়ে সবাই ওষুধ কোম্পানির দেখানো পথেই হাঁটছেন আর প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি মানুষকে প্রতিদিন কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খাওয়াচ্ছেন, যার শেষ পরিণতি নানারকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অকাল মৃত্যু!

এবারে শুনুন আরো চমকপ্রদ কাহিনী। যে জাপানি বিজ্ঞানী আকিয়া এন্ডো কোলেস্টেরল নিয়ে গবেষণা করে Statin ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন, পরবর্তীতে তাঁর নিজের রক্তে কোলেস্টেরল-এর আধিক্য ধরা পড়লে ডাক্তারগণ তাঁকে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করতে পরামর্শ দেন, কিন্তু তিনি তাঁরই আবিষ্কৃত Statin সেবনে অস্বীকৃতি জানান! ওদিকে মার্কিন গবেষক ব্রাউন ও গোল্ডস্মি ১৯৮০ সালে Statin ওষুধের বিরুদ্ধাচরণ করে বলেছিলেন, নিয়মিত Statin সেবন করলে ক্যান্সার-এর ঝুঁকি বাড়বে। কিন্তু ১৯৮৫ সালে নোবেল পদক পেয়ে তাঁরা তাঁদের আগের অবস্থান বেমালুম চেপে যান। ২০১২ সালে এসে জানা গেল, বিশ্বব্যাপী বহুল ব্যবহৃত ওষুধ Statin খেলে ডায়বেটিস হবে, মাংসপেশি ক্রমশ ঢিলা হয়ে যাবে আর যকৃত-এর কার্যক্ষমতা কমবে। এছাড়াও গর্ভবতী মায়েরা খেলে সন্তান বিকলাঙ্গ হবে, নারী-পুরুষের যৌনক্ষমতা ৫১% কমে যাবে আর মেয়েদের স্তন ক্যন্সার-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।

২০০৯ সালে এসে American Heart Journal একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশ করে যে, সাতটি উন্নত দেশের এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০৫ জন হার্টের রোগী যারা হার্ট অ্যাটাক-এর কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের ৭৫% রোগীর LDL-এর মাত্রা স্বাভাবিকেরও নিচে ছিল। তাহলে এতো দিন যে বলা হচ্ছিল LDL খারাপ কোরেস্টেরল, হার্ট-এর সমস্যা তৈরি করে, সেসব কথার ভিত্তি কোথায় গেল? কেনই-বা LDL নিয়ন্ত্রণের জন্য গাদা গাদা ওষুধ গেলানো হলো?!? জানি- কোনোদিনও এসব প্রশ্নের জবাব মিলবে না! ইদানীং অবশ্য বলা হচ্ছে, মানুষের বয়স ৪০ বছর পেরুলে LDL-এর মাত্রা 130ml/dl-এর উপরে থাকাই স্বাভাবিক। সুতরাং LDL একটু বেশি পেয়ে রোগীকে ওষুধ ধরিয়ে দিলে LDL-এর মাত্রা খানিকটা কমবে বটে, কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রক্তচাপ বেড়ে যাবে অর্থাৎ যেভাবেই বলি না কেন, জীবনটা হয়ে উঠবে ওষুধময়; মৃত্যু অবধি ওষুধ-বাণিজ্যের হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই!

সবশেষে হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, যাকে হৃদয়-বণিজ্যও বলা যেতে পারে। আমেরিকার বিখ্যাত জার্নাল JAMA, Dec 2014 সংখ্যায় জানানো হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য কার্ডিওলজিস্ট-দের নিয়ে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রত্যেক বছর বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য সদ্য উদ্ভাবিত নানা রকম ওষুধ ও অস্ত্রোপচারের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি প্রদর্শন। প্রশ্ন হলো- সব বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট একই সময়ে একই ছাদের নিচে সমবেত হলে ওই সময়টুকুতে পৃথিবীময় হৃদরোগে আক্রান্ত জরুরি রোগীদের অবস্থা কী হবে?!? কেননা তখন বেশ কয়েকদিনের জন্য বড় বড় হাসপাতালগুলো কার্ডিওলজিস্ট শূন্য হয়ে পড়ে; সবরকম জরুরি অপারেশন বন্ধ থাকে।

অবাক কান্ড, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দশ বছর ধরে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখল- বিশ্বের সকল নামকরা কার্ডিওলজিস্ট-গণ যখন বিশ্ব সম্মেলনে একত্রিত হন, তখন পৃথিবীব্যাপী হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার ৮% কমে যায় অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় সার্জারির কারণে অনেকের মৃত্যু হয়, যেটি সীমিত সময়ের জন্য স্থগিত থাকে! এতোকিছুর পরেও কার্ডিওলজিস্ট-দের নিয়ে বিশ্ব সম্মেলন বন্ধ হয়নি, বরং প্রত্যেক বছর এর জাঁকজমক ও জৌলুস ক্রমশ বাড়ছে। প্রদর্শিত হচ্ছে হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হবে এমন অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি।

২.
প্রিয় পাঠক, আপনি যদি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবসার ফাঁক-ফোকড় জেনে ইতোমধ্যে ক্লান্ত না হয়ে থাকেন তো এ পর্যায়ে আপনার জন্য আরো চমক অপেক্ষা করছে…!!! আপনি নিশ্চয় একমত হবেন যে, মানুষের অসুখ-বিসুখে রোগ নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রোগ নির্ণয় না হলে চিকিৎসা শুরু হবে কিসের ভিত্তিতে? কিন্তু আপনি কি জানেন- একই টেস্ট-এর মানদন্ড আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে দুই রকম! উদাহরণস্বরূপ বলা যায় :

Nutrient RDA (ইংল্যান্ড) RDI (আমেরিকা)
Vitamin D 5 meg 10 meg
Viamin C 80 meg 60 meg
Vitamin B12 2.5 meg 6 meg
Folic Acid 200 meg 400 meg
Chromium 40 meg 120 meg

এখন একজন ডাক্তার আমেরিকা থেকে পাস করে এসে যে ব্যবস্থাপত্র দেবেন, ইংল্যান্ড থেকে পড়ে এলে তাঁর ব্যবস্থাপত্র ভিন্ন হবে। আমেরিকায় ভিটামিন ডি পরীক্ষা করে স্বাভাবিক বিবেচিত হয়ে যদি ইংল্যান্ডে গিয়ে ডাক্তার দেখান, তবে তাকে ভিটামিন ডি কমানোর ওষুধ দেওয়া হবে। আবার ইংল্যান্ডবাসী তার শরীরের ভিটামিন সি স্বাভাবিক জেনে আমেরিকায় গিয়ে ডাক্তার দেখালে তাকে ভিটামিন সি ওষুধ দেওয়া হবে। মোট কথা আমরা দেশের মেধাবী সন্তানদের দিয়ে সাজানো এমন একটি ফাঁদের মধ্যে রয়েছি, যেখানে ডায়গনসিস (টেস্ট) করালেই আপনি কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত রোগী হয়ে যাবেন, যার নিরাময়ে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ সেবন করা লাগবেই! এছাড়াও অদক্ষ ও মনগড়া ডায়াগনসিসের ব্যাপার তো রয়েছেই।

প্রশ্ন হলো- এ থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই? আগেকার দিনে সভ্যতা যখন এতোখানি এগোয়নি, তখন কি রোগ নির্ণয় ছাড়াই ওষুধ সেবন চলত? তখন কি রোগ ভালো হতো না?

একটু খবর নিলেই জানতে পারবেন- অতীতে আমাদের জিহবা, চোখ, হাত-পায়ের নোখ আর নাড়ির স্পন্দন দেখে রোগ নির্ণয় করা হতো, যা ছিল নির্ভূল ও খরচবিহীন। কিন্তু আধুনিক বাণিজ্যিক কৌশলের কাছে সে বিদ্যা পরাজিত হয়ে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এখনকার মানুষ অত্যাধুনিক চিকিৎসার নামে তার নিজের রোগ সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনেই একের পর এক ওষুধ খেয়ে দেহের ‘বারোটা বাজিয়ে’ চলেছে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য আপনার রোগ সারানো নয়, বরং আপনাকে সারাজীবন রোগী বানিয়ে রেখে ডাক্তার ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি সুনিশ্চিত করা। আপনি যদি এই ফাঁদে ধরা দিতে না চান, তাহলে আপনাকে সনাতন পদ্ধতিতে ফিরে যেতে হবে।

প্রথম ধাপ জিহবা পরীক্ষা। সরাসরি পেট থেকে উদ্গীরিত নানা গ্যাস-এর ছাপ জিহবা-তে দৃশ্যমান থাকে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন- একেক মানুষের জিহবার রঙ একেক রকম। মূলত লালচে স্বাভাবিক রঙটি হচ্ছে মানুষের সুস্থতার প্রতীক। যদি সেখানে সাদা আবরণ পড়ে যায়, তার মানে পেটে গন্ডগোল আছে। সবার আগে পেট পরিষ্কারের চিকিৎসা করাতে হবে। যদি জিহবাতে ফোস্কা পড়ে, তবে সেটি আরো মারাত্মক রোগের ইঙ্গিতবাহী।

দ্বিতীয় ধাপ চোখের পরীক্ষা। মানুষের চোখের রঙ ও মণির পাশে নানা দাগ দেখে রোগ নির্ণয় করা যায়। এটাও নির্ভুল হয়। তবে সেজন্য চোখ পরীক্ষার নিখুঁত জ্ঞান থাকতে হবে।

তৃতীয় ধাপ হাত ও পায়ের নোখ পরীক্ষা। আপনার শরীরের ভেতরে যদি কোনোরকম সমস্যা থাকে তো সবার আগে হাত ও পায়ের নোখে তার ইঙ্গিত দৃশ্যমান হবে। এক বা একাধিক নোখ স্বাভাবিক ঔজ্বল্য হারিয়ে কালচে বর্ণ ধারণ করবে। এমনকি নোখের কিছু অংশ মরে/শুকিয়ে যেতে কিংবা পচন ধরতে পারে।

চতুর্থ ধাপ নাড়ির স্পন্দন বিবেচনা করে রোগ নিরূপণ। এটা এমন এক নিখুঁত পদ্ধতি- যেখানে আগামী ছয় মাসের মধ্যে হৃদযন্ত্রে সমস্যা হবে কিনা, পরবর্তী এক বছরের মধ্যে জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হবে কিনা, সবই বলে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কুসংস্কারের দোহাই দিয়ে এই পদ্ধতিকে প্রতিহত করা হয়েছে, যা এখন পৃথিবী থেকে বিলুপ্তির পথে। তবে প্রাচীন লোকজ চিকিৎসা পদ্ধতির বইপত্র ঘেঁটে এই বিদ্যা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়।

সব কথার শেষ কথা হচ্ছে আকুপ্রেসার। এই পদ্ধতি সবচেয়ে সহজ, নিরাপদ ও অধিক কার্যকর। আমাদের শরীরের সকল অর্গানগুলোর সুইচ পয়েন্ট হাত ও পায়ের তালুতে রয়েছে। আপনি হাত ও পায়ের তালুতে বিভিন্ন পয়েন্ট-এ নিয়মিত চাপ দিন; যেখানে ব্যাথা অনুভব করবেন, আকুপ্রেসার চার্ট দেখে বুঝে নিতে হবে সেগুলো কোন অঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত অর্থাৎ আপনার কোন অঙ্গগুলো আক্রান্ত। সেই অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করুন আর ব্যাথাযুক্ত পয়েন্টগুলোতে নিয়মিত চাপ দিতে থাকুন। এক পর্যায়ে ব্যাথাও কমে যাবে, রোগও সেরে যাবে, তা সে যত জটিল রোগই হোক না কেন। এই চিকিৎসার জন্য বাড়তি কোনো খরচ নেই আর কোনো ওষুধও লাগে না; উপরন্তু আপনি পুরোপুরি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত।

পরিশেষে বলতে চাই- আপনি কি আপনার মহামূল্যবান সম্পদ শরীরটিকে চিকিৎসা বাণিজ্যের কাছে সঁপে দিয়ে ওষুধের মধ্যে সাঁতার কাটবেন নাকি নিজেই নিজের সুস্থতা নিশ্চিত করবেন- সেটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে আপনার আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার উপর। যত কঠিন রোগেই আক্রান্ত হন না কেন, যদি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে প্রাকৃতিক নিয়মের কাছে ফিরে যেতে পারেন, তবে সম্পূর্ণ নিরোগ দেহ ফিরে পাওয়া সম্ভব। মনে রাখবেন- আমাদের দেহ স্রষ্টার দেওয়া শ্রেষ্ঠ দান। এই দেহকে ভর করেই আমরা পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব ধরে রাখি। সেই দেহকে অবহেলা করে অল্পতে বিনষ্ট করা হবে সবচেয়ে ভয়ংকর পাপ। তাই আসুন, স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস রেখে নিজেই নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রক হওয়ার চেষ্টা করি।


আরো বিভন্ন বিভাগের নিউজ