• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪২ পূর্বাহ্ন

জয়যাত্রা টিভির সেই ‘হাজেরা আপা’র কর্মকাণ্ড নিয়ে যা জানাল র‌্যাব

Md. Nazim Uddin / ৩৫ ভিউ টাইম
আপডেট : মঙ্গলবার, ৩ আগস্ট, ২০২১

চ্যানেল কক্স ডেস্ক:

সম্প্রতি জয়যাত্রা টেলিভিশনের ভোলা জেলা প্রতিনিধি তুহিন খন্দকারের সঙ্গে হেলেনা জাহাঙ্গীরের অন্যতম সহযোগী ও জয়যাত্রা টেলিভিশনের জিএম (অ্যাডমিন) হাজেরা খাতুনের একটি অডিও কথোপকথন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। অডিওটিতে শোনা যায়, জয়যাত্রা টেলিভিশনের সাংবাদিকদের গ্রুপ থেকে রিমুভ করার কারণ সম্পর্কে জানতে চান ভোলা প্রতিনিধি তুহিন। এর প্রতি-উত্তরে হাজেরা বলেন, ‘মাসিক চাঁদা সম্পর্কে জানা ছিল না আপনার? কমার্শিয়াল ফিও দেন নাই আপনি। তাই গ্রুপ থেকে রিমুভ করা হয়েছে।’

হাজেরা আরও বলেন, ‘জয়যাত্রা টেলিভিশনে নিউজ প্রচার ও লাইভ করার আগে অফিসে টাকা পরিশোধ ছাড়া কোনো নিউজ-লাইভ প্রচার হবে না।’

সোমবার (২ আগস্ট) রাতে পল্লবী থানায় সাংবাদিক আব্দুর রহমান তুহিন বাদী হয়ে একটি চাঁদাবাজির মামলা করেন। মামলায় জয়যাত্রা টিভির চেয়ারম্যান হেলেনা জাহাঙ্গীর, জেনারেল ম্যানেজার হাজেরা, প্রধান বার্তা সম্পাদক কামরুজ্জামান আরিফ, কো-অর্ডিনেটর সানাউল্ল্যাহ নূরী, স্টাফ রিপোর্টার মাহফুজ শাহরিয়ারসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়।

মামলার বাদী তুহিন অভিযোগ করেন, জয়যাত্রা টেলিভিশনের প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়ার নামে হেলেনা ও তার সহযোগীরা মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েছিলেন।

সম্প্রতি র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হন হেলেনা জাহাঙ্গীর। গ্রেফতারের পর র‍্যাবের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হাজেরা খাতুনের নাম প্রকাশ করেন। এরপর তাকে গ্রেফতার করা হয়। এই হাজেরা খাতুন ২০১৬ সালে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের ডিজিএম হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর ২০১৮ সালে জয়যাত্রা টিভি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জিএম (অ্যাডমিন) পদে নিযুক্ত রয়েছেন। হাজেরা মূলত দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ হেলেনার আর্থিক বিষয়াদি দেখভাল করতেন।

জানা যায়, জয়যাত্রা টিভির জেলা, উপজেলা ও দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের আর্থিক লেনদেন (চাঁদা) সংগ্রহ হতো হাজেরার হাত দিয়ে। যারা অনিয়মিত চাঁদা দিতেন তাদের জয়যাত্রা টেলিভিশনের সাংবাদিকদের গ্রুপ থেকে রিমুভ করে দিতেন তিনি। এরপর টাকা পরিশোধ করলে আবারও গ্রুপে যুক্ত করতেন হাজেরা।

ভাইরাল সেই কথোপকথনের কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই অডিও কথোপকথনে রিপোর্টার তুহিন হাজেরার কাছে জানতে চান, প্রতি মাসেই কমার্শিয়াল বিল দিতে হবে?

উত্তরে হাজেরা বলেন- প্রতি মাসে না, তবে পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আপাতত প্রতি মাসেই দিতে হবে।

তুহিন- আমার ব্যক্তিগতভাবে প্রতি মাসে এভাবে টাকা দেয়া সম্ভব না। সেক্ষেত্রে আমি যে জামানত দিয়েছি সেটা কি ফেরত পাওয়া সম্ভব?

হাজেরা- আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। প্রতি মাসের টাকা দিতে পারবেন না, আবার জামানতের টাকা ফেরত দিতে হবে- এই কথাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?

তুহিন- নিয়োগের সময় আমাদের প্রতি মাসে টাকা দেয়ার কথা বলা হয়নি।

হাজেরা- আপনাকে গ্রুপ থেকে রিমুভ করা হয়েছে, আপনার প্রতিনিধিত্ব আমরা বাতিল করিনি। গ্রুপ থেকে বাদ দেয়া না দেয়ার কি কোনো শর্ত ছিল নিয়োগের সময়?

তুহিন- গ্রুপে যুক্ত না থাকলে নিউজ আমরা কীভাবে পাঠাবো?

হাজেরা- আপনি কথা এভাবে বলবেন না। আমরা আপনাদের কাছে জিম্মি হয়ে যাইনি।

তুহিন- জিম্মি আমরা হয়েছি আপনাদের কাছে।

হাজেরা- গ্রুপে শুধু তারাই আছে যারা প্রতি মাসে টাকা পরিশোধ করছে এবং তাদের নিউজ আটকানো হয় না। আপনার নিউজ এভাবে যাবে না। নিউজ পাবলিশ হতে হলে কমার্শিয়াল দিতেই হবে।

তুহিন- অফিস আমাদের স্যালারি দেবে কিন্তু উল্টা এখন আমরা অফিসকে স্যালারি দেবো, আপা?

হাজেরা- আপনার কাছে কমার্শিয়াল চাওয়া হয়েছে, বেতন চাওয়া হয়নি।

তুহিন- নিয়োগের আগে এমন তো কথা ছিল না। এ পর্যন্ত আমাদের কি দিয়েছেন আপনারা?

হাজেরা- এমন শর্তে আমরা নিয়োগ দেইনি আপনাকে।

তুহিন- প্রতি মাসে টাকা দেবো শর্ত এটাও ছিল না।

হাজেরা- আপনি অনেক বাড়াবাড়ি করছেন।

তুহিন- বাড়াবাড়ি না আপা, সঠিক কথাটাই বলছি।

হাজেরা- আপনি আপনার মতামত জানিয়েছেন এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তবে এ বিষয়ে আর কারও সঙ্গে কথা বলবেন না। আপনার সঙ্গে বেতন নয় কমার্শিয়াল দেবেন সেই শর্ত হয়েছিল নিয়োগের আগে।

তুহিন- কমার্শিয়াল দিতে হবে এমন কোনো শর্ত নিয়োগের আগে ছিল না। এখন আমার নিউজ যাচ্ছে না কেন?

হাজেরা- কমার্শিয়াল না দিলে এখন আর কোনো নিউজ যাবে না। লাইভ করার জন্যও কমার্শিয়াল দিতে হবে। আপনি যদি লাইভ করতে চান তাহলে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে কমার্শিয়াল দিয়ে লাইভ করতে পারবেন।

তুহিন- প্রত্যেকটা অপশনেই টাকা লাগবে? নিউজ করতেও টাকা আবার লাইভ করতেও টাকা?

হাজেরা- হ্যাঁ, টাকা লাগবেই।

তুহিন- আমরা টাকা দিয়ে নিউজ প্রচার করবো; তাহলে আপনার প্রতিষ্ঠানের কাজ কি?

হাজেরা- ও তাই নাকি? আমাদের প্রতিষ্ঠান কি ঠেকাই পড়ছে আপনাদের নিউজ প্রচার করার জন্য? আপনারা বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কমার্শিয়াল তো ঠিকই নেন।

তুহিন- আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, আমরা চাঁদাবাজি করি না।

হাজেরা- চাঁদাবাজি ছাড়া এমনিতেই চলেন?

তুহিন- চাঁদাবাজি করি না। আমার প্রতিষ্ঠান আছে, পত্রিকা আছে। টাকা দিয়ে আমি নিউজ প্রচার করব না, আমি যে জামানত দিয়েছি তা ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

হাজেরা- ঠিক আছে।

এদিকে, আজ মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) দুপুরে কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর তার জয়যাত্রা টেলিভিশনে জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা এককালীন দিতে হতো। এছাড়া প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রতি মাসে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হতো। জয়যাত্রা টিভি বিশ্বের প্রায় ৩৪টি দেশে সম্প্রচারিত হতো। যেখানে দেশের গুরুত্ব বিবেচনায় এক থেকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রতিনিধিরা নিয়োগ পেতেন।

হেলেনার এসব টাকা সংগ্রহ ও প্রতিনিধিদের টাকার বিনিময়ের নিয়োগের জন্য জয়যাত্রা টিভির জিএম (অ্যাডমিন) হাজেরা খাতুন কাজ করতেন।

তিনি বলেন, হাজেরা খাতুন ২০০৯ সালে কুমিল্লার একটি কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করে হেলেনা জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন মিরপুরে একটি গার্মেন্টসে অ্যাডমিন (এইচআর) পদে চাকরি শুরু করেন। তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীরের নিকটাত্মীয় এবং একইসঙ্গে কর্মদক্ষতা গুণে হেলেনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন।

ফলে ২০১৬ সালে তিনি ‘জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন’র ডিজিএম হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর ২০১৮ সালে জয়যাত্রা টিভি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জিএম (অ্যাডমিন) পদে নিযুক্ত হন। হাজেরা মূলত দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ হেলেনার আর্থিক বিষয়াদি দেখভাল করতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানান।

এ সম্পর্কে হাজেরা খাতুনকে জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানায়, জয়যাত্রা টিভি ২০১৮ সাল থেকে হংকংয়ের একটি ডাউনলিংক চ্যানেল হিসেবে সম্প্রচার হয়ে আসছে। যার ফ্রিকোয়েন্সি হংকং থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে। ফ্রিকোয়েন্সির জন্য হংকংকে মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করতে হতো।

তিনি বলেন, সম্প্রচারের জন্য রিসিভার জয়যাত্রা টিভি বা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে ক্যাবল ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। প্রতিনিধিরা ক্যাবল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সম্প্রচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে চাকরিচ্যুত করা হতো। বাংলাদেশের প্রায় ৫০টি জেলায় সম্প্রচারিত হয় এ জয়যাত্রা টিভি। টিভি চ্যানেলটি রাজধানী ও জেলা পর্যায়ের পাশাপাশি মফস্বল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পনা নেয়া হয়। যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অধিকসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা যায়।

জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন সম্পর্কে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ফাউন্ডেশনে ডোনার, জেনারেল মেম্বার, লাইফ টাইম মেম্বার ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে অর্থ সংগ্রহ করা হতো। এই সংগঠনের প্রায় ২০০ জন সদস্য রয়েছেন। যাদের কাছ থেকে সদস্যপদ বাবদ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়েছে, যা সামান্যই মানবিক কাজে ব্যবহার করে জয়যাত্রা টিভি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা-চালানো হতো। অবশিষ্ট অর্থ তার (হেলেনা) সন্তানদের নামে সঞ্চয় করা হতো বলে হাজেরা জানান।

হাজেরার সঙ্গে গ্রেফতার অন্যজন সানাউল্ল্যাহ নূরী। তিনি জয়যাত্রা টিভির প্রতিনিধি সমন্বয়ক ছিলেন। তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীরের নির্দেশনায় প্রতিনিধিদের সমন্বয় করতেন। প্রতিনিধিদের কেউ মাসিক টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বা গড়িমসি করলে তিনি ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন। এলাকায়ও তার নামে চাঁদাবাজি অভিযোগ রয়েছে। তিনি গাজীপুরে গার্মেন্টস সেক্টরে ব্যাপক চাঁদাবাজি করে তার একটি অংশও জয়যাত্রা টিভিকে দিতেন বলে জানান। এছাড়া তিনি গাজীপুর ও আশপাশ এলাকার অনুমোদনহীন জয়যাত্রা টিভির সম্প্রচার নিশ্চিত করতেন।


আরো বিভন্ন বিভাগের নিউজ