আবু তাহের ॥
শনিবার কক্সবাজারে এসেছিলেন সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। জেলার শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে রবিবার তিনি মতবিনিময় সভা করেন। সভার বিষয় ছিল কক্সবাজারের উন্নয়ন। আমলা থেকে জনপ্রতিনিধি সকলে মন্ত্রী এবং তাঁর সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে গেলেন কক্সবাজার জেলায় হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। কিন্তু জেলার বেহাল সড়কের কথা কেউ বলেন না। আমার মনে পড়ে গেলে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা’র একটি কৌতুক।
হোজ্জা তখন কাজী। একদিন বিচারে বসেছেন। ফরিয়াদি তার অভিযোগের বয়ান দিচ্ছে। হোজ্জা মনযোগ দিয়ে তার কথা শুনলেন। বাদীর বলা শেষ হলে মাথা ঝাকিয়ে বললেন, ‘তোমার কথাই ঠিক’।
এবার আসামি বলে, ‘হুজুর, আমার দু’টা কথা ছিল’। হোজ্জা বললেন, ‘ঠিক আছে তুমি তোমার বক্তব্য বল’। আসামির বক্তব্যও মনযোগ দিয়া শোনার পর হোজ্জা বললেন, ‘তোমার কথাই ঠিক’।
পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন হোজ্জার স্ত্রী। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে বললেন, ‘দু’জনই ঠিক হয় কিভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক, অথবা ফরিয়াদির কথা ঠিক’।
হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে সমর্থনসূচক হাসি দিয়ে বললেন, ‘বিবি তোমার কথাই ঠিক’। হোজ্জার এই কৌতুকের সারমর্ম হচ্ছে- খোশ রাখতে হলে, তোষামোদ করতে হয়।
মন্ত্রী আসার আগের দিন দেখেছি হলিডে হোটেলের সামনে থেকে লাবনী পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে রং লাগানো হচ্ছে। কারণ মন্ত্রী এই ভিআইপি সড়ক দিয়ে হোটেলে যাবেন। মত বিনিময় সভাতেও দেখলাম সবাই সেই একই কায়দায় রং লাগিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বলেন জেলার সড়কগুলোর অবস্থা অতি চমৎকার। আমার আর হজম হলো না। সভার পরিবেশ নষ্ট করলাম। বললাম- মাননীয় মন্ত্রী জেলার কোন সড়কই ভাল নেই। পর্যটন শহরের অবস্থা অতি খারাপ। বিপুল অর্থ ব্যয় করে মেরিন ড্রাইভ সড়ক করা হয়েছে। সেটিও কাজে আসছে না- কলাতলীর এক কিলোমিটার অংশের কারণে। অতি সম্প্রতি সড়কের এই অংশের নির্মাণ কাজ শেষ করেছে পৌরসভা। কিন্তু এত সংকীর্ণ করেছে দু’টি গাড়ি এক সাথে যাতায়াত করতে পারে না। মনে হচ্ছে আগের ভাঙ্গা সড়কই ভাল ছিল। এখানে এখন দীর্ঘ যানজটে দু:সহ অবস্থা। বললাম- সড়কের পাশে রং দেখে খুশি হওয়ার মন্ত্রী আপনি নন। জেলার বেহাল সড়কগুলোর জন্য কিছু করেন।
মনে হলো মন্ত্রী পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। শেষে তাঁর বক্তব্যে ভুতুড়ে শহরের কথা তুলে ধরে বলেছেন- ‘পর্যটন শহরের জন্য এমন অবস্থা বড়ই বেমানান’। মাননীয় মন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প যেখানে, খানা খন্দকে ভরা এমন সড়ক সেখানে বড়ই বেমানান। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে সরকার। বেহাল কক্সবাজারের রোগ সারাবে কি, সংস্থাটি নিজেই রোগাক্রান্ত। নানা বাধার কারণে কিছুই করতে পারছেনা বলে হতাশ খোদ সংস্থার চেয়ারম্যান।
গেল সপ্তাহে কক্সবাজার ঘুরে গেলেন সাবেক জেলা প্রশাসক সাজ্জাদুল হাসান। তিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সচিব। ইনানীর রয়েল টিউলিপ হোটেলে তাঁর সাথে ডিনারের আমন্ত্রণ পেলাম। রাতে এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ডিনারে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিলনা। দীর্ঘদিন পর প্রিয় এই মানুষটির সাথে সাক্ষাত করার সুযোগ পাব এই প্রত্যাশায় সেখানে গেলাম। সাথে আরো দুই সাংবাদিক বন্ধু। হোটেলের লবিতে প্রবেশ করতেই দেখা পেলাম। সেখানে কক্সবাজারের পদস্থ আমলা, শীর্ষ রাজনীতিবিদ, এমপি সবাই রয়েছেন। দেখলাম সাজ্জাদুল হাসান উপস্থিত সবার উপর ক্ষোভ ঝাড়ছেন। পর্যটন শহরে ময়লা আবর্জনার স্তুপ কেন, নালা নর্দমাগুলো অবৈধ দখলে কেন, সড়কগুলোর বেহাল দশা কেন- এই নিয়ে তিনি অতি ক্ষুব্দ। ডিনারের পর আরো ঘন্টাখানিক সেখানে তাঁর সাথে ছিলাম। পুরোটা সময় দেখলাম প্রিয় শহর কক্সবাজারের করুণ হাল নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে গেলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন- ঢাকায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দিবেন।
এই ঘটনার দুই দিন পরই জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে একটি জরুরী সভা আহবান করেন। পৌর মেয়র কাউন্সিলরগণ সহ বিভিন্ন দফতরের কর্তারা ছিলেন। শহরের বেহাল দশার উন্নয়ন ঘটাতে সভায় কিছু সিদ্ধান্ত হল। আগামী এক মাসের মধ্যে পৌর শহর আবর্জনা মুক্ত হবে। সড়কের সংস্কার হবে। এক মাস পর একই সভা একই স্থানে আবার বসবে। এখন দেখার পালা এই এক মাসে কি উন্নতি হয়।
একটা গল্প বলে এই লেখা শেষ করতে চাই। শহরের এক কুমারী মেয়ে হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে গেল। সবাই ভাবল-বাচ্চা মেয়ে বুঝতে পারেনি, একটা ভুল হয়ে গেছে। ঘটনাটা কোনোরকমে ধামাচাপা দেওয়া হলো। কিছুদিন পর দেখা গেল মেয়ে আবার গর্ভবতী। গ্রামের লোকজন সেবারও ঘটনাটা সামলে নিল। কী সর্বনাশ, তৃতীয় বৎসরে আবার একই কান্ড। সালিশ বসল। মেয়েকে ডেকে পাড়ার সর্দার বললেন, ও রহিমা, ব্যাপারটা কী?
রহিমা ক্ষীণকণ্ঠে বলল, আমি কাউকে না বলতে পারি না। না বলতে আমার লজ্জা লাগে।
আমাদের এই শহরে একজন পৌর পিতা ছিলেন। রহিমার মতো তিনিও কাউকে না বলতে পারতেন না। যে কেউ তার কাছে আসতেন শহরের নালা নর্দমা লিখে নিতেন। সেই নালা নর্দমার উপর বহুতল ভবন উঠলে তিনি লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে রাখতেন।
এখন এই নালা নর্দমা নিয়ে পৌরবাসীর কষ্টের শেষ নেই। সামান্য বৃষ্টির জলে থৈ থৈ করে। বাসা-বাড়ি অফিস দোকান তলিয়ে যায়। সড়কগুলোকে মনে হয় খর¯্রােতা নদী। পৌরসভার বর্তমান কর্তারা পাপের সেই বোঝা বয়ে যাচ্ছেন। অসহায় জনপ্রতিধিদের তালিকা তৈরিতে দিন যায়। নালা নর্দমা দখল করে দুর্গন্ধ গায়ে মেখে বসে আছে যারা, তাদের উচ্ছেদে সাহস কারো হয় না। রহিমার লজ্জা নিয়ে কি আমাদের সময় যাবে? বড় দুর্ভাগা এই শহরবাসী।
# কৈফিয়ত: দীর্ঘ বিরতির পর ‘অল্পকথা গল্পকথা’ নামে কলাম লেখা ফের শুরু করলাম। অনিয়মিত হলেও লেখার প্রতিশ্রুতি থাকল