বিশেষ প্রতিবেদন
জেলার বাঁকখালী নদীর দুইপাড়ে জেগে উঠা হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধারে গড়িমসি করছে প্রশাসন। বর্তমানও দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। দিনের পর দিন এসব জমি অবৈধ দখলে চলে গেলেও যেন দেখার কেউ নেই।
অভিযোগ উঠেছে, এক শ্রেণীর ভূমিগ্রাসী ও প্রভাবশালীমহল হাজার কোটি টাকা মূল্যের এসব জমি একের পর এক দখলে নিচ্ছে। যে যার মতো করে এসব সরকারি জমি দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এতে স্থানীয় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভূমিতায় রয়েছে। তবে স্থানীয় পরিবেশবাদিরা বলছেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করা, জেলা প্রশাসনের লোক দেখানো তালিকা তৈরী ও আইনী জটিলতা সহ নানা মারপ্যাচে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিগ্রাসী চক্র এসব জমি গিলে খাচ্ছে। তারা বলছেন, মহামান্য হাইকোর্টের সু-স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু, এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে জেলা প্রশাসন গড়িমসি করছে। কারণ, বাঁকখালী নদীর পাড় যাদের দখলে রয়েছে, তাদের অধিকাংশ জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কমিটির সঙ্গে জড়িত।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণের সভাপতি দীপক শর্মা দিপু বলেন, ‘বাঁকখালী নদীর জমি দখল নিয়ে জেলা প্রশাসন আইওয়াশ করছে। কারণ, বাঁকখালী নদীর জমি দখলকারি প্রত্যেক রাঘব-বোয়ালরা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। তাই তাদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন টু শব্দও করে না। আমরা মনে করি প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে আন্তরিক হবেন। এতে করে খুব সহসাই উক্ত জমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে’।
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘২০১৪ সালে বাঁকখালী নদীর দখলদারদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে- বাঁকখালী নদীর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ দখলে যাওয়া জমি উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু, জেলা প্রশাসন দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও উক্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে’। তিনি আরো বলেন- গত কয়েক মাস আগে জেলা প্রশাসন একটি তালিকা তৈরী করেছে। কিন্তু, ওই তালিাকায় প্রভাবশালীদের নাম নেই। তাই তালিকাটি বাদ দিয়ে পুনরায় পূর্ণাঙ্গ আরেকটি তালিকা তৈরি করে প্রকৃত ভূমি গ্রাসীদের উচ্ছেদ করা হউক’।
‘আমরা কক্সবাজারবাসি’র সমন্বয়ক কলিম উল্লাহ বলেন- ‘অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের সম্বয়হীনতা, সিদ্ধান্তহীনতা সহ নানা সমস্যা রয়েছে। একইভাবে মামলা জটিলতাও আছে। বিশেষ করে প্রভাবশালী চক্র হওয়ায় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছে। তাই, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোর হয়ে উক্ত জমি দখল উচ্ছেদ করতে হবে এবং উদ্ধার হওয়া জমি গুলোতে রাজশাহীর আদলে পার্ক নির্মাণ করতে হবে’।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: আশরাফুল আবছার বলেন, ‘জেলা প্রশাসন ইচ্ছে করলেও অবৈধ দখলে থাকা বাঁকখালী নদীর জমি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। ইতিমধ্যে ‘বিএস’ জরিপের আওতায় জেলা প্রশাসন অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা তৈরী করেছে। কিন্তু, মহামান্য হাইকোর্ট ওই তালিকার বদলে ‘সিএস’ জরিপের আওতায় নতুন একটি তালিকা তৈরী করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। এতে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে উক্ত জমি গুলো উদ্ধারে বিলম্ব হচ্ছে। এরপরও বিষয়টি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছে একটি প্রস্তাবনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামীতে অবশ্যই অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে’।
কক্সবাজার জেলার বাঁকখালী নদীর দৈর্ঘ্য ৯০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২৫ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে অবৈধ দখলদারদের বিভিন্ন স্থাপনা। জেলার প্রধান নদী হওয়ায় বাঁকখালীর ওপর অন্তত সাত লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। অথচ জনগুরুত্বপূর্ণ এ নদী অবৈধভাবে দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলছে প্রভাবশালীরা। আবার অনেকেই নদী ভরাট করে আবাসন প্লট তৈরি করে বিক্রিও করছে। কিন্তু, রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযানে গড়িমসি করছে।
দখলের চিত্র: বাঁকখালী নদী ও নদীর দুই তীর দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বসতবাড়ি, পাকা ও সেমিপাকা দোকানপাট, ময়দার কল, চিংড়িঘের, হোটেল, শৌচাগার, মুরগির খামার, লবণের গুদাম ও বরফকলের মতো স্থাপনা। এ নদীর আশপাশ এলাকায় পাহাড় কাটার কারণে বর্ষাকালে কাটা পাহাড়ের মাটি পানির ¯্রােতে বিভিন্ন নালা, খাল-বিল হয়ে নদীতে এসে পড়ছে। ফলে ভরাট হচ্ছে নদী। কোথাও কোথাও রাবার ড্যাম দিয়ে এর গতিপথ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। ফলে বেড়ে গেছে লবণাক্ততা।
দূষণের চিত্র: দখলের পাশাপাশি চলছে নদীদূষণের প্রতিযোগিতা। দূষণের এ প্রতিযোগিতায় ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গে যোগ হয়েছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার পৌরসভাও। বাঁকখালী নদীর তিনটি স্থানে (পেশকারপাড়া, কস্তুরাঘাট ও বিআইডব্লিউটিএ কার্যালয়সংলগ্ন) প্রতিনিয়ত পড়ছে পৌরসভার বর্জ্য। শহরের হোটেল-মোটেলের বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে এ নদীতে।
আদালতের নির্দেশনা: বাঁকখালী নদী রক্ষায় সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়েরকৃত এক রিট (নং ৮৩২৫/২০১৪) মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে বাঁকখালী নদী দখলকারীর তালিকা তৈরি করে তাদের উচ্ছেদ ও দূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধ করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আদালত নদীতীর চিংড়ি বা তামাক কিংবা ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে ইজারা প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে একটি রুলও জারি করেন। এ রুলে নদীটিকে কেন প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করার নির্দেশ দেয়া হবে না বা কেন প্রাথমিক প্রবাহ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ পূর্বক তা রক্ষা করার নির্দেশ প্রদান করা হবে না এবং নদীর উভয় তীরের উপকূলীয় বন ফিরিয়ে আনার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন আদালত।