[ইমাম খাইর]
মহেশখালীতে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণকারী জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগরদের আশ্বস্থ করে স্বরাস্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, প্রশাসনের কাছে মাথা পেতে দিয়ে আত্মসমর্পণকারীদের খুন ও ধর্ষণ ছাড়া বাকি সব মামলা তুলে নেওয়া হবে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া হবে। সুযোগ পেয়েও যারা আত্মসমর্পণ করেনি তারা বড়ই ভুল করেছে।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে জলদস্যু ও অস্ত্রকারিগরদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাস্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
কক্সবাজারে জেলা পুলিশ আয়োজিত অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন, অতীতে যে জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছিল, এখন তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। সুন্দরভাবে জীবন কাটাচ্ছে। অন্ধকার জগতের এই জীবন কতটা কষ্টের, সেটি তারা টের পেয়েছে। নিজের কষ্ট, দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে তারা আত্মসমর্পণ করেছিল।
আজকে যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তারাও বুঝতে পেরেছে অন্ধকার জগতে জীবন যাপন করা কতটা কষ্টকর। তারা নিজের ভুল বুঝতে পেরে, নিজের ও পরিবারের কষ্টের কথা বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করেছে।
যারা এখনো আত্মসমর্পণ করেনি, তাদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, যারা এখনো আত্মসমর্পণ করেনি, আমরা সবার নাম-ঠিকানা পেয়ে গেছি। তারা যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে না আসে, তাহলে তাদের কঠোর পরিণতি ভোগ করতে হবে।
পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আসাদুজ্জামান খাঁন এমপি বলেন, দেশের যেখানে যাই প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের চিত্র ভেসে আসে। মানুষের আস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বদলে দিচ্ছেন বাংলাদেশ। কক্সবাজারের উন্নয়নে সমানতালে কাজ করছেন।
বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এই দেশকে দস্যু, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত করে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এদেশকে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত করা হবে।
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে। এই এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। সাবরাংকে পর্যটনের জন্য বিশেষ জোন হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। তিন লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। সুন্দরবন এখন দস্যুমুক্ত। আমরা জোর গলায় বলতে পারি, দেশকে দস্যু, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত করতে কাজ করছে এ সরকার।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেরর গেস্ট অব অনার আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে কোন জঙ্গি, সন্ত্রাসী, অপরাধীর স্থান হবেনা। যে কোন সময় ৯৯৯ নাম্বারে কল করে পুলিশের অনিয়মের বিরুদ্ধেও বলতে পারবেন। সে যেই হোক অপরাধীর ছাড় নেই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিভিন্ন ব্রান্ডের ১৫৫ টি অস্ত্র, ২৭৫ টি গুলিসহ সাগর উপকূলের ১২ বাহিনীর ৯৬ সদস্য আত্মসমর্পণ করে। সেখান শীর্ষস্থানীয় ১২ জন অস্ত্র তৈরীর কারিগরও রয়েছে। আত্মসমর্পণকারীদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন স্বরাস্ট্রন্ত্রী।
অনুষ্ঠানের আগে ৯৬ জন তালিকাভুক্ত জলদস্যু, অবৈধ অস্ত্রধারী ও অস্ত্র তৈরীর কারিগরকে সেফহোম থেকে প্রিজন ভ্যানে করে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। আত্মসমর্পণকারী প্রত্যেককে দেয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকার আর্থিক অনুদান।
পুলিশ লাইন মসজিদের পেশ ইমাম আব্দুল মান্নানের কোরান তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন। জীবনের ভুল স্বীকার করে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিরাজ বাহিনীর প্রধান সিরাজদৌল্লাহ। অভিশপ্ত জীবন থেকে ফিরে মুক্ত জীবনের চিত্র তুলে ধরেন ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর আত্মসমর্পণকারী জলদস্যু নুরুল আমিন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন- কক্সবাজার -১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম, কক্সবাজার-২ (কুতুবদিয়া-মহেশখালী) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান।
এছাড়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, মহেশখালীর ইউএনও জামিরুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ¦ আনোয়ার পাশা, মেয়র মকছুদ মিয়া, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরীফ বাদশা, জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি সাংবাদিক তোফায়েল আহমদ, ওসি প্রভাষ চন্দ্র ধরসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন বিটিভির কক্সবাজার প্রতিনিধি জাহেদ সরওয়ার সোহেল।
কক্সবাজার জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় সক্রিয় জলদস্যু ও অস্ত্র তৈরীর কারিগরদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা উপলক্ষ্যে ‘আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান’টির মধ্যস্থতা করেন আনন্দ টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো ইনচার্জ এমএম আকরাম হোসাইন। অনুষ্ঠানের পর তাদের অস্ত্র মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে রয়েছে – অস্ত্র তৈরীর বিখ্যাত কারিগর জাফর আলম, মহেশখালীর কালারমারছড়ার আলোচিত জিয়া বাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমান জিয়া, তার বাহিনীর সদস্য মানিক, আয়াতুল্লাহ, আব্দুস শুকুর, সিরিপ মিয়া, একরাম ও বশিরসহ অন্তত ১৫ জন।
চেয়ারম্যান তারেক শরীফের অনুসারী হিসেবে পরিচিত কালা জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রধান জাহাঙ্গীর আলম, সদস্য আবুলু, সোনা মিয়া, জমির উদ্দীনসহ প্রায় ১৫ জন, নুনাছড়ির মাহমুদুল্লাহ বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ আলী, সেকেন্ড ইন কমান্ড বদাইয়াসহ ১৫ জন, ঝাপুয়ার সিরাজ বাহিনীর প্রধান সিরাজউদ্দৌল্লাহ, নলবিলার মুজিব বাহিনীর প্রধান মজিবুর রহমান প্রকাশ শেখ মুজিব এবং কুতুবদিয়ার লেমশীখালীর কালু বাহিনীর প্রধান মোঃ কালু প্রকাশ গুরা কালুসহ তার বাহিনীর ১৫/২০ জন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করা ৪৩ জলদস্যুর মধ্যে ৩৭ জনকে সাংবাদিক এমএম আকরাম হোসাইন মধ্যস্থতা করেন। সরকারীভাবে তারা প্রতিজন ১ লক্ষ টাকা করে আর্থিক অনুদানও পেয়েছে।
এছাড়া গত ১৬ ফেব্রুয়ারী ইয়াবা ও অস্ত্রসহ টেকনাফে আত্মসমর্পণ করে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি। সেটিও এমএম আকরাম হোসাইন মধ্যস্থতা করেন। ওই সময় তিনি চ্যানলে টোয়েন্টিফোরের বিশেষ প্রতিবেদক ছিলেন।