চ্যানেল কক্স ডেস্কঃ
পেঁয়াজের বাজার নিয়ে কারসাজি করার অভিযোগে দেশের ৪০ পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ফেঁসে যাচ্ছেন। তারমধ্যে শুধু কক্সবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী রয়েছেন ৩০ জন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও শুল্ক গোয়েন্দার কাছে যেতে হচ্ছে পেঁয়াজ কারসাজির সঙ্গে জড়িত এসব হোতাদের। পেঁয়াজ সিন্ডিকেটে থাকা সন্দেহভাজন ব্যবসায়ীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদও খতিয়ে দেখছে দুদক। শুল্ক গোয়েন্দা দেখবে আমদানি ও বিক্রির নথি। এরই মধ্যে বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে তলব করা হয়েছে।
ফেঁসে যাওয়া কক্সবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন- মাদ্রাসা রোডের এআর এন্টারপ্রাইজ, টেকনাফের ছোটহাজি মার্কেটের এসএস ট্রেডিং, কুলালপাড়ার মেসার্স জাবেদ এন্টারপ্রাইজ, কলেজপাড়া এলাকার মেসার্স কবির অ্যান্ড সন্স এবং চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ। তবে মিয়ানমার থেকে গত দেড় মাসে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করেছেন-মোহাম্মদ হাসিম, যদু চন্দ্র দাশ, মোহাম্মদ জব্বাব, মোহাম্মদ সজিব, মোহাম্মদ সেলিম, মোহাম্মদ সাদ্দাম, মোহাম্মদ কামরুল, জিয়াবুল হক, সৈয়দ করিম, মোহাম্মদ বাহাদুর, মোহাম্মদ মাসুম, মোহাম্মদ হাবিব ও বার্মাইয়া শক্কুর। আবার শীর্ষ আমদানিকারকরা যেসব অখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের মধ্যে কক্সবাজারের উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে-নিউ বার্মিজ মার্কেটের তাজমহল শপিং মল, টেকনাফ বাস স্টেশনের হামিদ অ্যান্ড ব্রাদার্স, বার্মিজ মার্কেটের গফুর এন্টারপ্রাইজ, টেকনাফ রশিদ মার্কেটের পারভীন এন্টারপ্রাইজ, পুরান পালানপাড়ার মিফতাহুল এন্টারপ্রাইজ, গোদার বিলের মিয়া হোসেন ব্রাদার্স, গনি মার্কেটের চৌধুরী ট্রেডার্স, লামার বাজার রোডের এম এস কবির ট্রেডিং, কে কে পাড়ার বড় হাজী ট্রেডার্স, চকরিয়ার পালাকাটা এলাকার রেড ডট এন্টারপ্রাইজ, শাহপরীর দ্বীপের মাহী অ্যান্ড ব্রাদার্স, কে কে পাড়ার মেসার্স আবসার অ্যান্ড ব্রাদার্স, ওলিয়াবাদের মেসার্স জুনায়েদ এন্টারপ্রাইজ, কলেজপাড়ার শুক্কুর অ্যান্ড ব্রাদার্স, শাহারবিলের ইয়াসিন ফিশিং, কলেজপাড়ার কবির অ্যান্ড সন্স, লামার বাজারের এম এ ট্রেডিং, মাসুম এন্টারপ্রাইজ, কুলালপাড়ার হাজী নূর ট্রেডিং, বাসস্টেশনের এন ইসলাম এন্টারপ্রাইজ, উপরের বাজার এলাকার বেলাল এন্টারপ্রাইজ, গণি মার্কেটের মা এন্টারপ্রাইজ, মাদ্রাসা রোডের বিসমিল্লাহ ট্রেড সেন্টার প্রমুখ।
চট্টগ্রামের পেঁয়াজ ব্যবসায়রীরা হচ্ছে- চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের হাশেম ট্রেডার্স, এমএইচ ট্রেডিং কোম্পানি, সৌমিক ট্রেডার্স, এশিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এআর ইন্টারন্যাশনাল, কাওসার ট্রেডার্স, রফিক সওদাগর এবং এসআর ইন্টারন্যাশনাল।
পেঁয়াজের বাজার নিয়ে কারসাজি করা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন- চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের হাশেম ট্রেডার্স, এমএইচ ট্রেডিং কোম্পানি, সৌমিক ট্রেডার্স, এশিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এআর ইন্টারন্যাশনাল, কাওসার ট্রেডার্স, রফিক সওদাগর এবং এসআর ইন্টারন্যাশনাল। এ ৪০ পেঁয়াজ ব্যবসায়ীর আর শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
আমদানিকারকের পাশাপাশি চট্টগ্রামের কমিশন এজেন্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়েছে তাদের। আবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনও পাঠিয়েছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। এই প্রতিবেদনে সার্বিক অবস্থার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কেও অবহিত করা হয়েছে। তথ্য দেওয়া হয়েছে পেপারলেস মার্কেটে জড়িত অখ্যাত ৯০ ব্যবসায়ীর ব্যাপারেও। খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৫১ কমিশন এজেন্টের তালিকা নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সিবিএন-কে জানান, ‘আমরা বেশি দিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি পেঁয়াজের বাজার। আমদানিকারক, কমিশন এজেন্ট ও পাইকাররা যোগসাজশ করে বাজার অস্থির করেছে। ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য গোপন রাখতে তারা পেপারলেস মার্কেট তৈরি করেছে। অখ্যাত ৯০ ব্যবসায়ীকে সামনে রেখে এ মার্কেট চালু করা হয়েছিল। আমরা এমন ৯০ জনের হদিস পেয়েছি। আবার ১৩ জন ব্যবসায়ী ও কমিশন এজেন্ট পেয়েছি যারা বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছে। গোয়েন্দা সংস্থাকে আমরা যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করেছি। মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। প্রয়োজনে সব তথ্য দেব দুদককেও।
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদন প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘বাজার অস্থির করে সাধারণ মানুষের পকেট যারা কেটেছে তাদের কারও শেষ রক্ষা হবে না। এ ব্যাপারে সরকার খুব কঠোর। আমরা যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি তাতে এ পর্যন্ত কোন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা উল্লেখ করেছি। ব্যবসায়ীদের নিয়ে করা চারটি বৈঠকের তথ্য দিয়েছি। চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীদের জেল পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে।’
জানা গেছে ৪০ জনের একটি সিন্ডিকেট অখ্যাত ৯০ ব্যবসায়ীকে সামনে রেখে মুখে মুখে দাম নির্ধারণ করে আমদানি করা পেঁয়াজ পাইকারি মোকামে বিক্রি করেছেন সারাদেশে। সরকার আমদানির তথ্য ধরে অভিযান চালানোর শঙ্কা থাকায় অখ্যাত এ ব্যবসায়ীদের দিয়ে পেঁয়াজও আনছেন শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। বার্মিজ পণ্যের আড়ালে অখ্যাত এ ব্যবসায়ীরা আমদানি করেছেন পেঁয়াজ। পেঁয়াজ কেনাবেচার তথ্য গোপন করতে পেপারলেস মার্কেট তৈরি করেছেন তারা। এই মার্কেটের দালিলিক কোনো প্রমাণ না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেননি ভ্রাম্যমাণ আদালত।
চট্টগ্রামে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, পেঁয়াজের কারসাজিতে জড়িত কারোরই শেষ রক্ষা হবে না। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের শীর্ষ ১৩ প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য নিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। এসব আমদানিকারকের যোগসাজশে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা।
সর্বোচ্চ পেঁয়াজ আমদানির কথা স্বীকার করলেও অতিরিক্ত মুনাফা করার অভিযোগ অস্বীকার করে এমএইচ ট্রেডিংয়ের মালিক মোহাম্মদ হাশেম বলেন, ‘দেশে আনা পেঁয়াজ ন্যূনতম লাভে বিক্রি করেছি আমরা। পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য হওয়ায় এখানে আমাদের লোকসানও অনেক বেশি। তার পরও কেন পেঁয়াজের দাম এতটা বেড়েছে, তা খতিয়ে দেখুক সরকার। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরাই পেঁয়াজের দাম নিয়ে কারসাজি করছে।’ মিয়ানমারের শীর্ষ পেঁয়াজ আমদানিকারক যদু চন্দ্র দাশ এর আগে বলেন, বাজার স্বাভাবিক রাখতে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছেন। সে দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় দেশেও দাম বেড়েছে। তিনি কোনো অন্যায় করেননি। অতিরিক্ত মুনাফাও করেননি।
আবার খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়াবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন আমার কাছ থেকে কমিশন এজেন্টদের তালিকা চেয়েছিল। আমি ৫১ জনের তালিকা তাদের সরবরাহ করেছি। বাজার নিয়ে খেলেছে আমদানিকারকরা। তারা নামে-বেনামে পেঁয়াজ এনে ইচ্ছামতো বাজারে সরবরাহ করেছে। এখন আমাদেরও দোষ দিচ্ছে প্রশাসন। আমরা তো আমদানিকারকের বেঁধে দেওয়া দাম থেকে ৫০ পয়সা কমিশন নিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ‘পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজিকারী ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিতে মজুদবিরোধী আইনে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক্ক গোয়েন্দা দপ্তরসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা অসাধু পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের ধরতে তদন্ত শুরু করেছে।
অসাধু ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে কাল সোমবার তলব করেছে শুল্ক্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। কত দামে পেঁয়াজ এনেছে, কার কাছে কত দামে বিক্রি করা হয়েছে- এসব তথ্য জানতে চাওয়া হবে। নথি পর্যালোচনা করে অতি মুনাফাকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্রঃ সিবিএন।