• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২৬ পূর্বাহ্ন

টাকা নিয়ে বিদেশের পরিবর্তে পরপারে পাঠিয়ে দিল দালাল

নিউজ রুম / ১৭০ ভিউ টাইম
আপডেট : মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৯
নিহত মাজেদ আলী - ফাইল ছবি

বিদেশ যাওয়ার জন্য দালালের হাতে টাকা দিয়ে আর বিদেশ যাওয়া হলো না হতভাগ্য মাজেদ আলীর (৪৫)। সম্প্রতি এমনি একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জে। ক্লুলেস এই ঘটনাটি দীর্ঘ আড়াই মাস তদন্ত করে এর রহস্য উদঘাটন করেছে র‌্যাব-১১।

মঙ্গলবার দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জের র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান বাহিনিটির অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল কাজী শমসের উদ্দিন।

সংবাদ সম্মেলনে লেঃ কর্ণেল কাজী শমসের উদ্দিন জানান, বিদেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নাজমা বেগম (৩৫) ও তার স্বামী মাজেদ আলী (৪৫) পাবনা থেকে মহিউদ্দিন বুলু নামের এক আদম ব্যবসায়ীর কথায় নারায়ণগঞ্জে আসে। বুলু তাদেরকে ফতুল্লার টাগারপাড় এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় রাখে। পরে পাসপোর্ট, ভিসা, মেডিকেল ও বিভিন্ন কাজের কথা বলে বুলু তাদের কাছে থেকে ২ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেয়। বুলু তাদের বিদেশ না নিয়ে নানা ছলচাতুির করে কালক্ষেপন করতে থাকে।

এদিকে গত ১০ মার্চ মহিউদ্দিন বুলু বিকালে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে কৌশলে মাজেদ আলীকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। রাতে বুলু ফিরে আসলেও মাজেদ আলী আর ফিরে আসেনি। তখন থেকে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আসলেও মাজেদ আলী বাসায় ফিরে না আসায় নাজমা বেগম স্বামীর জন্য কান্নাকাটি করলে আদম-বেপারী মহিউদ্দিন বুলু কৌশলে পালিয়ে যায় এবং নাজমা বেগমের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

এদিকে ১৩ মার্চ নাজমা বেগম র‌্যাব-১১ বরাবর একটি অভিযোগ দেয়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে র‌্যাব বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। তদন্তের এক পর্যায় র‌্যাব আদম ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন বুলুকে সন্দেহভাজন হিসেবে ফতুল্লার শিবু মার্কেট এলাকা থেকে আটক করে। কিন্তু র‌্যাব বুলুর কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে মাজেদ আলীর বিষয়ে আশানরুপ কোন তথ্যই উদঘাটন করতে পারেনি।

পরে তথ্য প্রযুক্তি সহায়তায় র‌্যাব জানতে পারে ১০ মার্চ সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানাধীন মেঘনা নদীর তীর এলাকায় অবস্থান করছিলো মহিউদ্দিন বুলু ও মাজেদ আলী। পরবর্তীতে অভিযুক্ত মহিউদ্দিন বুলু নারায়ণগঞ্জে ফিরে আসলেও নিখোঁজ মাজেদ আলীর ব্যবহৃত মোবাইলটি ওই এলাকা থেকে বন্ধ পাওয়া যায়।

এঘটনার মূল সন্দেহভাজন মহিউদ্দিন বুলুকে আটকের পরেও মাজেদের কোনো সন্ধান পাচ্ছিলো না র‌্যাব। এক পর্যায়ে তাকে রিমান্ডে এনেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাতেও এই ঘটনার কোন যুতসই তথ্য পাওয়া যাচ্ছিলো না। কিন্তু র‌্যাব তাদের ছায়া তদন্ত অব্যাহত রাখে। এক পর্যায়ে তদন্তের ধারাবাহিকতায় কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকার সোহেল নামক এক নৌকার মাঝির নাম পায় র‌্যাব। সে ভাটের চর ও দাউদকান্দি বাজারের মধ্যে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যাত্রী আনা-নেওয়া করে।

গোপন সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন অর্থাৎ ১০ মার্চ আদম বেপারী মহিউদ্দিন বুলু, নিখোঁজ মাজেদ আলী ও অজ্ঞাত এক লোককে নিয়ে সোহেল মেঘনা নদীতে নৌকা চালিয়ে ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব ১০ মে কুমিল্লার দাউদকান্দি বাজার ঘাট হতে নৌকার মাঝি সোহেল (২১) কে আটক করে এবং তার নৌকাটি জব্দ করে। গ্রেফতারের পর র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নৌকার মাঝি সোহেল ঘটনার লোমহষর্ক বর্ননা দিয়ে জবানবন্দী প্রদান করে।

জানা যায়, আদম বেপারী মহিউদ্দিন বুলু ও বাবু একত্রে সোহেলের নৌকায় মাজেদ আলীকে পাশবিক নির্যাতন করে, গলা টিপে ও নাক-মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মেঘনা নদীতে তার লাশ ভাসিয়ে দেয়। এর আগে ১০ মার্চ সকালে তার এলাকার পূর্ব পরিচিত সুলতান মাহমুদ বাবু ১ হাজার টাকায় সারাদিনের জন্য ওই নৌকাটি ভাড়া করে। আনুমানিক সকাল ১১ টায় দাউদকান্দি হতে বাবু নৌকায় গজারিয়ার কালিরবাজার এালাকায় আসে। পরে বিকেলে বাবু নৌকা নিয়ে দাউদকান্দি ব্রিজের পশ্চিম পার্শ্বের চাষীর বালুর মাঠ এলাকায় আসলে সেখান থেকে বুলু ও মাজেদ আলী ওই নৌকায় ওঠে। নৌকায় উঠে নদীতে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকে তারা। একপর্যায়ে সন্ধ্যা আনুমানিক ৭ টায় মেঘনা নদীর গোয়াগাছিয়ার মোড়ে এসে পৌছলে বাবু মাজেদকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ধস্তাধস্তি করে ছাউনির ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলে। বুলু ও বাবু কিল ঘুষি মেরে মাজেদকে নৌকার পাটাতনে শুইয়ে দেয়। বুলু মাজেদের বুকের উপর উঠে বসে এবং বাবু মাজেদের পায়ের উপর বসে জোরে পা চেপে ধরে। মাজেদ বাচাঁও, বাচাঁও চিৎকার করলে বুলু নৌকার মাঝি সোহেলকে ইঞ্জিনের শব্দ বাড়িয়ে দিতে বলে, যাতে পার্শ্ববর্তী নৌকা থেকে কেউ চিৎকার শুনতে না পায় এবং সোহেল তাই করেছিল।

এক পর্যায়ে ১৫ মিনিট ধরে বুলু ও বাবু পাশবিক নির্যাতন করে এবং গলা টিপে ও নাক-মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে মাজেদকে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে তারা লাশ মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়। লাশ ফেলে দেয়ার পর বুলু পাটাতনে টর্চ লাইটের আলোতে রক্ত দেখলে সোহেলকে রক্ত পরিষ্কার করতে বলে। সোহেল বুলুর নির্দেশে নদী থেকে পানি তুলে রক্ত পরিষ্কার করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বুলু ও বাবু সোহেলকে ১ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে দাউদকান্দি ব্রীজের পশ্চিম পাশে নেমে যায়।

এই ঘটনাটি গ্রেফতারকৃত নৌকার মাঝি সোহেল স্বীকার করে গত ১৩ মে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিঃ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাউছার আহমেদের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী প্রদান করে। নৌকার মাঝি সোহেলের জবানবন্দী থেকে প্রকাশ পাওয়া মাজেদ আলীর হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা ও হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত সুলতান মাহমুদ বাবুকে সোমবার (১৩ মে) গভীর রাতে গজারিয়ার শিমুলিয়া থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১১।

বাবুকে গ্রেফতারের মাধ্যমে মাজেদ আলী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সকল আসামীকেই আইনের আওয়াতায় আনা হয়েছে বলে জানান মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা র‌্যাব-১১ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন পিপিএম ও মেজর তালুকদার নাজমুস সাকিব।


আরো বিভন্ন বিভাগের নিউজ