• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৩ পূর্বাহ্ন

মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে নৌকায় উঠতে বাধ্য করা হয় খোকনকে

নিউজ রুম / ১৫৯ ভিউ টাইম
আপডেট : শনিবার, ১৮ মে, ২০১৯
Sমেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে নৌকায় উঠতে বাধ্য করা হয় খোকনকে - এএফপি

এমদাদুর রহমান মিলাদ, বিশ্বনাথ (সিলেট) :

সম্প্রতি লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার উপকূলবর্তী ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ হন বিশ্বনাথের যুবক রেদওয়ানুল ইসলাম খোকন (২৬)। দালালচক্র মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া নিয়ে যায় রেদওয়ানুল ইসলাম খোকনকে। সেখানে খোকন সহ অন্যান্য যুবকদেরকে গেম ঘরে বন্দি করে রাখা হয় এবং ইতালি পাঠাতে খোকন ও তার সহযাত্রীদের নৌকায় উঠতে বাধ্য করে সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে উপজেলার নওধার মাঝপাড়া গ্রামে রেদওয়ানুল ইসলাম খোকনের বাড়িতে গেলে গণমাধ্যমকর্মীদের এমন অভিযোগ করেন খোকনের বাবা-মা।

যেভাবে লিবিয়া যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয় খোকন ও তার পরিবারকে 

বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের নওধার গ্রামের ইলিয়াস আলী ও জোছনা বেগম দম্পতির ছোট ছেলে রেদওয়ানুল ইসলাম খোকন। সে সিলেট সরকারি কলেজে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। নওধার গ্রামের পার্শ্ববর্তী বৈরাগী বাজারে খোকনের বড় ভাই রেজাউল ইসলাম রাজুর ‘ফিজা এন্ড কোম্পানী’নামে একটি ব্যবসা রয়েছে। যেখানে খোকন ও তার বাবা বেশিরভাগ সময়ই বসতেন। প্রায় ৬মাস পূর্বে বৈরাগী বাজারের পার্শ্ববর্তী কাঠলীপাড়া গ্রামের চমক আলীর ছেলে আদম ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম রফিক তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ইতালি পাঠানোর সুবর্ণ সুযোগের কথা বলেন। আর এতে খোকন রাজি হয়ে গেলে পরিবারের সকলেই টাকার জন্য হিমসিম খান। একপর্যায়ে দালাল রফিকের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বমোট সাড়ে ৮লাখ টাকার বিনিময়ে খোকনকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন তার পরিবার।

যেভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠানোর কথা ছিল 
সাড়ে ৫লাখ টাকায় বাংলাদেশ থেকে বিমানে লিবিয়া, সেখান থেকে এক মাসের মধ্যে আরো আড়াই লাখ টাকায় জাহাজে করে এবং লিবিয়ার সেনাবাহিনীর হেলিকাপ্টারের প্রহরায় খোকনকে ইতালি পৌঁছানোর কথা হয় দালাল রফিকের সাথে খোকনের বাবা-মার। ছেলেকে ইউরোপ পাঠানোর আশায় খোকনের বাবা ইলিয়াস আলী বৈরাগী বাজারস্থ তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ফিজা এন্ড কোম্পানী’র নামে ব্রাক ব্যাংক বিশ্বনাথ শাখা থেকে ৮লাখ টাকা লোন তোলেন। এরপর সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রায় ৬মাস পূর্বে খোকনকে লিবিয়া পাঠাতে উত্তোলনকৃত লোনের টাকা থেকে প্রথমে সাড়ে ৫লাখ টাকা দালাল রফিককে প্রদান করেন ইলিয়াস আলী।

ফলে গত নভেম্বর মাসের শেষের দিকে খোকনকে লিবিয়া পাঠায় দালাল রফিক। কথা ছিল লিবিয়া পৌছার পর এক মাসের মধ্যে সেখান থেকে ইতালি পৌছানো হবে খোকনকে এবং ইতালি পৌছার পর চুক্তির বাকি আড়াই লাখ দেয়া হবে। কিন্ত লিবিয়া পৌঁছার এক সপ্তাহের মধ্যে চুক্তির বাকি টাকা সহ মোট ৮লাখ ২০হাজার টাকা খোকনের পরিবারকে চাপ দিয়ে আদায় করে নেয় দালালচক্র।

লিবিয়ায় গেইম ঘরে যেভাবে রাখা হয় : ৮লাখ টাকা আদারে পর গেম ঘর নামক একটি তালাবদ্ধ ঘরে বিশ্বনাথে শিমুলতলা গ্রামের ইর্শাদ আলী মাস্টারের পুত্র দিলাল মিয়া, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ছোট ভাই আহসান হাবিব শামীম, তার শ্যালক গোলাপগঞ্জের কামরান আহমদ মারুফ, ফেঞ্চুগঞ্জের বিলাল সহ অন্যান্য যুবকদের সাথে রাখা হয় রেদওয়ানুল ইসলাম খোকনকে। ওই ছোট্র ঘরে শতাধিক লোককে রাখা হয়। একটি টয়লেট থাকায় অনেক কষ্ট হয় তাদের। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলে, খাবার-গোসল ছাড়া পড়নের কাপড় পড়ে থাকতে হয় তাদেরকে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সাথে কথা হলে খোকন জানিয়েছিলেন- তাদেরকে তালাবদ্ধ ঘরে অনাহারে রাখা হয়। প্রতিদিন একবার মাত্র একটি করে রুটি দেয়া হত। কেউ খাবারের জন্য এক বারের পর দুই বার কল করলে শাস্তি সরুপ সবাইকে ৭২ ঘন্টা পর খাবার দেয়া হত। একজন মাত্র ১০মিনিট শুয়ে থাকার পর, অন্যজনকে শুবার সুযোগ দিয়ে ৪ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়। তাদের এভাবেই চলে গত ১১ মে পর্যন্ত টানা ৫ মাস।

টাকা আদায়ে দালালের কৌশল 
খোকনকে গেম ঘরে আটকে রাখার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে খাবারের জন্য বাড়ি থেকে বিকাশের মাধ্যমে ৩হাজার টাকা দালালকে দেওয়া হত। তাও এই তিন হাজার টাকা থেকে খোকন পেতেন মাত্র ৩শত টাকা। লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রার এক সপ্তাহ পূর্বে বাড়িতে বড় ভাই রেজাউল ইসলাম রাজুর কাছে ফোন করেন খোকন। এসময় শেষ বারের মতো ৩হাজার টাকা পাঠাতে বলেন খোকন।

খোকনের বাঁচার আকুতি

গেম ঘরে যখন দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম তখন বাড়িতে ফোন করে মায়ের কাছে বাঁচার আকুতি জানান খোকন। গেম ঘর থেকে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে বলেন। এরপর খোকনকে গেম ঘর থেকে ছেড়ে দিতে অথবা দেশে ফেরত পাঠাতে দালাল রফিককে বলেন খোকনের পরিবার। তখন দালাল রফিক তাদেরকে বলে গেম ঘর থেকে মুক্ত করতে আরো ৮লাখ টাকা দিতে হবে। কিন্ত এই টাকা দেয়া তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয়নি। তাই গেম ঘরে থাকতে হয় খোকনকে। এরপর গত ১১ মে অন্যদের সাথে খোকনকে ইতালি পাঠানো জন্য গেম ঘর থেকে সমুদ্রের পাড়ে নেয়া হয়। নৌকায় উঠার পূর্বে খোকন একটি ভয়েস ম্যাসেজের মাধ্যমে তার ভাইকে জানায়, কিছু সময়ের মধ্যে সে যাত্রা করবে। এরপর থেকে তার সাথে পরিবারের আর কোন যোগাযোগ হয়নি।

জিম্মি করে ভূমধ্যসাগরে নৌকায় উঠতে বাধ্য করা হয়

গত ১১ মে তিউনিসিয়ার উপকূলবর্তী ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী নৌকা ডুবির ঘটনার পর থেকের খোকনের জন্য দুঃশ্চিন্তায় পড়ে পরিবার। নৌকা ডুবিতে নিহত ২৭ বাংলাদেশির পরিচয় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি প্রকাশ করে। এই তালিকায় বিশ্বনাথের নিখোঁজ খোকনের নাম থাকায়। ওই নৌকার যাত্রীর মধ্যে যাদেরকে জীবিত উদ্ধার করা হয় তাদের একজন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বেলাল। একপর্যায়ে বেলালের গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান নিখোঁজ খোকনের পরিবারের লোকজন। এরপর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বেলালের সাথে তাদের কথা হলে বেলাল জানান তার সঙ্গে একই নৌকার যাত্রী ছিলেন খোকন। তখন বেলাল তাদেরকে দালাল চক্রের লৌহমর্ষক কুকর্মের কথাগুলো জানান।

বেলাল জানান- একটি বড় স্টীলের নৌকায় করে লিবিয়া থেকে তিউনিসিয়ার উপকূলবর্তী ভূমধ্যসাগরে নিয়ে যায় গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে দালালরা অভিবাসীদেরকে একটি ছোট নৌকায় উঠতে বলে। ফলে দু’দিকেই মরণের ভয় দেখে সামান্য বাঁচার আসায় তারা নৌকায় উঠতে বাধ্য হন। এই ছোট নৌকাটি সাথে সাথে ডুবে যেতে শুরু করে। নৌকাডুবিতে প্রায় ৬০ জনের মতো পানিতে ডুবে মারা যায় ও বিলাল সহ ১৬ জনকে সেখান থেকে জীবিত উদ্ধার করে জেলেরা।

সন্তান হারিয়ে নির্বাক বাবা-মা

সন্তান হারিয়ে নির্বাক খোকনের বাবা-মা। পরিবারের চলছে শোকের মাতন। তাদেরকে সান্তনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা।

ঘটনার পর থেকে স্বপরিবারে আত্মগোপনে দালাল রফিক : কাঠলীপাড়া গ্রামের চমক আলীর ছেলে আদম ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম রফিক। সে দীর্ঘদিন ধরে আদম পাচার করে যাচ্ছেন। শুধু রফিকই নয়, তার স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে পিংকি আক্তার, পুত্র পারভেজ ও আব্দুর রহমানও জড়িত রয়েছে আদম পাচারে। গত ১২ মে রাতে খোকনের ভাই রাজুর মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়েছে পিংকি জানায়- খোঁকনকে ইতালী পৌঁছানো হয়েছে। কিন্ত ১৩ মে রাতে বাড়ি থেকে দালাল রফিক স্বপরিবারে পালিয়েছে গেছে। তাদের ব্যবহৃত সকল মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।

দালালদের গ্রেফতার ও ফাঁসি দাবি

খোকনের বাবা ইলিয়াস আলী ও বাবা জোছনা বেগমের দাবি দালাল রফিকুল ইসলাম চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের ছেলেকে সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করিয়েছে। সে জন্য দালাল রফিক ও তার মেয়ে দালাল পিংকি সহ সকল দালালদেরকে গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবি জানান তারা। তাদের মতো এভাবে যাতে আর কোন মা-বাবাকে তাদের সন্তান হারাতে না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা।


আরো বিভন্ন বিভাগের নিউজ