• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন

অনেক কষ্টে পুলিশের চাকরিতে দিলাম! কব্জি বিচ্ছিন্ন জনির মা

চ্যানেল কক্স ডেস্ক / ১৬ ভিউ টাইম
আপডেট : মঙ্গলবার, ১৭ মে, ২০২২

হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের দরজার সামনে নীরবে একা চোখের পানি ফেলছিলেন কনস্টেবল জনি খানের মা সুরাইয়া বেগম। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় আসামির দায়ের কোপে কব্জি বিচ্ছিন্ন হওয়া এই পুলিশ সদস্যের হাতের কব্জি প্রায় ১০ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় জোড়া লাগানো হয়েছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আল মানার হাসপাতালে এ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাজেদুর রেজা ফারুকীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যদের চিকিৎসক দল এই অস্ত্রোপচারে অংশ নেন। তারা হলেন- হাসপাতালটি প্লাস্টিক সার্জন ডা. হাসান নাজিরুদ্দীন সুমন, ডা. শাকেরা, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. আলাউদ্দীন ও ডা. মোস্তফা কামরুল ইসলাম।
ছেলের অবস্থা জানতে চাইলে হাউমাউ করে কেঁদে কনস্টেবল জনি খানের মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। সরকার যেন আমার সন্তানের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা করে। আর ওই নরপশুটাকে যেন শাস্তি দেয়। আমার ছেলে সরকারি কাজে, সরকারি সেবা করতে গেছিলো। সরকারি কাজে যাইয়া আমার ছেলের এই অবস্থা হইছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে কইতে চাই, আমার সন্তানের যেন সুচিকিৎসা করেন। এই দুনিয়ায় আমার এই সন্তান ছাড়া আর কিচ্ছু নাই, কোনো সম্পদও নাই। জনিই আমার পোলা, আমার মাইয়া, আমার বাপ।’
সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘হাসপাতালে আসার পর বিকেলে আমার পোলাকে (ছেলেকে) দেখেছি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ডাক্তার কথা বলতে দেয় নাই। শুধু নিজের চোখ দিয়া দেইখা আইছি। ডাক্তাররা কইছে ভালো আছে জনি। তবে সুস্থ হইতে সময় লাগবে।’

জনির মা আরও বলেন, ‘আমি কুমিল্লায় আছিলাম। কুমিল্লা থেইক্কা আজকে ঢাকায় আইছি। আমি খুবই নিরীহ একটা মানুষ। কোনো অর্থ সম্পদ কিচ্ছু নাই, অনেক কষ্টে পোলাডারে মানুষ কইরা পুলিশের চাকরিতে দিছিলাম। দেশবাসী সবাই আমার সন্তান্ডার জন্য দোয়া করবেন। সবাই দোয়া করলে কাজে লাগবো।’

রোববার (১৫ মে) দুপুরের দিকে বিষয়টি (ছেলের কব্জি বিচ্ছিন্ন হওয়া) জানার পর কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারছিলেন না জনির মা। কারণ মোবাইল ছিল না তার কাছে। পরে জনির ফোন ধরেন আরেক পুলিশ সদস্য। তিনি চট্টগ্রামে যেতে চাইলে সেই পুলিশ সদস্য নিষেধ করে বলেন, জনিকে ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে।

জনি খানের মা আরও বলেন, ‘কুমিল্লা থাইক্কা ঢাকায় আমাকে লইয়া আসার মতো কেউ নাই। আমি কুমিল্লা থাইক্কা এই হাসপাতালে পোলার খোঁজে একাই চইলা আইছি। আমার স্বামী চট্টগ্রামে থাকে। সে নিজেই অসুস্থ। তাই তাকে এখনো বলা হয়নি তার ছেলের হাতের এই অবস্থা। আট বছর ধইরা পুলিশের চাকরি করে জনি। জনির এক পোলা আছে। তার বয়স দুই বছর হয়নি এখনো।’

জানতে চাইলে আল মানার হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শহিদুল্লাহ বলেন, একজন মানুষের সম্পূর্ণ দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে যাওয়া হাতে অনেকগুলো অংশ থাকে। সেগুলোকে আলাদা করে সিরিয়ালি বের করতে হয়। এরপর টানা প্রায় ১০ ঘণ্টার অপারেশনটি করতে হয়েছে। অপারেশনটি ছিল খুবই জটিল।

তিনি বলেন, রোগী এখন পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত। আমি দেখেছি তার হাতের স্বাভাবিক রঙ চলে এসেছে। নার্ভ যেগুলো জোড়া দেওয়া হয়েছে, সেগুলোরও ফাংশন চলে আসতে শুরু করেছে। হাতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় হাতেও উষ্ণতা চলে এসেছে।

রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটুকু রয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মো. শহিদুল্লাহ বলেন, আমাদের হাসপাতালে এখন পর্যন্ত এমন যেসব রোগীর চিকিৎসা দিয়েছি তারা প্রত্যেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। আশা করছি তিনিও (জনি) শিগগির সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবেন।

আসামি গ্রেফতার সম্পর্কে জানতে চাইলে সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শিবলী নোমান জাগো নিউজকে বলেন, থানা পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা ইউনিট আসামি গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করছে। আশা করছি দু-একদিনের মধ্যে ভালো খবর দিতে পারবো।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম রশিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, আহত জনি খানের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ পুলিশ সদর দপ্তর বহন করছে এবং তার চিকিৎসায় সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। হাসপাতালে পুলিশের দুজন সদস্য ডিউটিরত রয়েছেন। এ ঘটনায় একজন আসামিকে গতকাল রোববার রাতেই গ্রেফতার করা হয়। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে আমাদের একাধিক টিম অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, আসামি ধরতে গিয়ে আসামির দায়ের কোপে কব্জি বিচ্ছিন্ন হওয়া পুলিশ সদস্য জনি খানের চিকিৎসার সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছে পুলিশ সদর দপ্তর। তার সুচিকিৎসার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দেশনা দিয়েছেন। পুলিশের কল্যাণ ট্রাস্টসহ জেলা পুলিশ থেকেও তার চিকিৎসায় সহয়তা করা হবে। নিজের জীবনকে বাজি রেখে সাহসী কাজের জন্য ভূমিকা রাখায় আর্থিক অনুদানও তাকে দেওয়া হবে। এছাড়া পুলিশ সদর দপ্তর সর্বোচ্চ সহয়তা করবে।

এর আগে রোববার (১৫ মে) সকাল ১০টার দিকে লোহাগাড়া থানার পদুয়া ইউনিয়নের লালারখিল এলাকায় আসামির ধারালো দায়ের কোপে পুলিশ সদস্য জনি খানের হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এছাড়া আরেক পুলিশ সদস্য আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশ কনস্টেবলে জনি খানকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঘটনার পর হামলাকারী কবির আহমদ পালিয়ে যান।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কবির আহমদ (৩৫) পদুয়া ইউনিয়নের লালারখিল এলাকার মৃত আলী হোসেনের পুত্র। তিনি এলাকায় বেপরোয়া ও দুর্ধর্ষ হিসেবে পরিচিত। নানা অপরাধে জড়িত তিনি। রোববার নিয়মিত মামলায় তাকে গ্রেফতারে অভিযান চালায় পুলিশ।

লোহাগাড়া থানার এসআই ভক্ত চন্দ্র দত্ত, এএসআই মজিবুর রহমান, কনস্টেবল জনি খান ও শাহাদাত হোসেন অভিযানে অংশ নেন। এসময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে কবির আহমদ ধারালো দা দিয়ে কনস্টেবল জনি খানের হাতে কোপ দিয়ে পালিয়ে যান। দায়ের কোপে জনির কব্জি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এ বিষয়ে কথা বলতে লোহাগাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ আতিকুর রহমানের মোবাইলে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তিনি বিষয়টি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। এরই মধ্যে কবির আহমদকে ধরতে বেশ কয়েক স্থানে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। তবে তাকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি।

এ বিষয়ে সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শিবলী নোমান বলেন, সকালে নিয়মিত মামলার আসামি ধরতে গেলে লালারখিল এলাকায় আসামিপক্ষের লোকজন হামলা চালান। এতে কনস্টেবল জনি ও শাহাদাত আহত হন। জনির বাম হাতের কব্জি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। শাহাদাতকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।


আরো বিভন্ন বিভাগের নিউজ