নিজস্ব প্রতিনিধি:
সীমান্ত দিয়ে দেদারছে আসছে ভয়ঙ্কর মাদক আইস ও ইয়াবা। কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই আইস-ইয়াবার বড় চালান জব্দ করছেন। বিভিন্ন সময়ে অভিযানে তালিকাভুক্ত এবং এর বাইরে থাকা মাদক কারবারিরা আটক হয়েছে। কিন্তু অধরা থেকে যাচ্ছে অধিকাংশ নেপথ্যের নায়করা। নানা কৌশলে তারা মাদকের এ অবৈধ ব্যবসা জিইয়ে রেখেছে।
রবিবার (৮ এপ্রিল) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারজন মাদক পাচারকারীকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ। এই সময় তাদের কাছ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় আনা একটি সাব-মার্সিবল পাম্প জব্দ করা হয়। পাম্পের ভেতরেই ছিলো ১২ হাজার পিচ ইয়াবা।
এদের মধ্যে একজন ছিল কক্সবাজার সদরের পিএমখালী এলাকার ফয়সাল। তিনি ওই ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি মোঃ শাহ আলমের প্রথম পুত্র এবং বিতর্কিত ইউপি সদস্য লুৎফা তাহেরার চাচাতো ভাই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আটক ফয়সাল শুধুমাত্র বাহক। টাকার বিনিময়ে সে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চালান বহন করে। আলোচিত নুরুল আবছার-জাহাঙ্গীর ইয়াবা সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য সদ্যধৃত এই ফয়সাল। তাকে আটকের পরে গণমাধ্যমে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে কক্সবাজার তার নিজ এলাকা পিএমখালী জুড়ে চলে আলোচনা-সমালোচনা।
আরও জানা যায়, ফয়সাল সিন্ডিকেটের ইয়াবা পাচারকারী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসলেও ঢাকায় উদ্ধারকৃত ইয়াবাগুলোর মূল মালিক বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আবছার ও জাহাঙ্গীর। তারাই মূলত এই সিন্ডিকেটটির দেখভাল করছে। ফলে পাচারকারী ফয়সাল আটক হলেও উক্ত ইয়াবার মূল গডফাদাররা রয়ে গেছে ধরাছোয়ার বাইরে। এই এলাকার ইয়াবা ডিলার বা গডফাদার হিসেবে অধিক পরিচিত পিএমখালীর নুরুল আবছার এবং জাহাঙ্গীর। এই আবছার হলো পিএমখালীর সংরক্ষিত ইউপি সদস্য লুৎফা তাহেরার আপন ভাই। এবং জাহাঙ্গীর হলো আবছারের বিশ্বস্ত অংশীদার। দুজনেই একসঙ্গে ইতিপূর্বে বিশাল মাদকের চালান সহ পুলেশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলো। এছাড়াও বিভিন্ন সময় এই সিন্ডিকেটে সহযোগী হিসেবে নাম উঠে এসেছে নব-নির্বাচিত ইউপি সদস্য লুৎফা তাহেরারও। গণমধ্যমের অনুসন্ধানেও ইয়াবার মূল গডফাদার হিসেবে এই জনপ্রতিনিধির নাম একাধিকবার উঠে এসেছে।
সম্প্রতি সিন্ডিকেটটির আরও তিন সদস্য একই ভাবে রাজধানী ঢাকা থেকে আটক হয়। চক্রটির অন্যতম পাচারকারি মেহেদি ও বাবুসহ তিন সদস্য ২৯ জানুয়ারী ঢাকায় ইয়াবাসহ ডিএমপির হাতে ধরা পড়ে। মেহেদী পিএমখালী এলাকার শেখ নবীর ছেলে। পরে ২ ফেব্রুয়ারী শেখ নবীর বাড়ি থেকে প্রায় ৮ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র্যাব-১৫। ওই যাত্রায় র্যাবের হাত থেকে শেখ নবী ও তার স্ত্রী সাহিদা পালিয়ে রক্ষা পায়। এভাবে করে মাদকের বিশাল বিস্তৃর্ণ জাল পেতে রেখেছে আবছার-জাহাঙ্গির সিন্ডিকেট। তারাই পিএমখালী এলাকায় ইয়াবার ধারক-বাহক বলে ব্যাপক কুখ্যাতি কুড়িয়েছে। তাদের কারণে এলাকার উঠতি অনেক যুবক-ছাত্র ফাঁদে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। অত্র এলাকাবাসীর দাবি, তাদেরকে আটক করলে এই এলাকা থেকে ইয়াবা ব্যবসা অনেকটা বন্ধ হয়ে যাবে।
এলাকার সচেতন ব্যক্তিরা জানান, পিএমখালী এলাকাটি বাঁকখালী নদী কুলঘেষা হওয়ায় ফিশিংবোট দিয়ে অহরহ ইয়াবার চালান খালাস সম্পন্ন করে নুরুল আবছার-জাহাঙ্গীর সিন্ডিকেট। তাদের কাছ থেকে পাইকারী ও খুচরা মূল্যে ইয়াবা নিয়ে কক্সাবাজারসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার করে। আবার এদের প্রায় সকলের বিরুদ্ধে মাদক দ্রব্য আইন ও হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা ও ইয়াবা ছিনতাইকারীদের ঝামেলা এড়াতে তারা চুক্তিভিত্তিক ইয়াবা পাচার করার জন্য বিভিন্ন খেটে খাওয়া মানুষকে নিয়োগ দিয়েছে আবছার-জাহাঙ্গীর। চুক্তিতে দরিদ্র লোকজনদের ফাঁদে ফেলে গ্রাহক নিয়োগ করে তারা। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাদেরকে আবার জামিনে মুক্ত করার ব্যবস্থাও করে জাহাঙ্গীর।
আরো জানা গেছে, গ্রামের বেকার কিশোর যুবক যারা রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর, ইয়াবা আবছার-জাহাঙ্গীররা মূলত ইয়াবা বহনের ফাঁদে তাদের কাজে লাগিয়ে থাকে। একারণে পিএমখালীর বিভিন্ন এলাকার সমাজ আজ কলুষিত হতে চলেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল ইয়াবা কারবারি মো. নুরুল আবছার এবং জাহাঙ্গীর তাদের দুই প্রেমিকাসহ দুই যুগল একই সাথে ইয়াবা পাচার করার সময় সীতাকুণ্ডের বারআউলিয়া হাইওয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়লে চক্রটির সব তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে।
ওই সময়ে বারআউলিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আহসান হাবীব জানান, কক্সবাজার থেকে ঢাকামুখী শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো ব- ১৫-১২৬৪) তল্লাশি চালালে দুই যুবক ও যুবতীর কাছে ২০০০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। পরে তাদেরকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। আটককৃতরা হলো কক্সবাজারের গর্জনিয়া গ্রামের শফিউল আলমের মেয়ে জমিলা আক্তার টুম্পা (২১) ও তার প্রেমিক একই এলাকার দক্ষিণ বাংলা বাজার নয়াপাড়া গ্রামের মো. সাহাবুদ্দিনের পুত্র নুরুল আবছার (২১), টুম্পার বান্ধবী টেকনাফ থানার মিনা বাজার (নূর কবির মেম্বারের বাড়ির পার্শ্বে) গ্রামের মৃত আব্দুল রশিদের মেয়ে সালমা আক্তার (২০) ও তার প্রেমিক একই এলাকার মো. ফরিদুল আলমের পুত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম (২৮)। এদের মধ্যে আবছার কক্সবাজার পলিটেকনিক কলেজের ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্র।
ওসি আরো জানান, থানায় জিজ্ঞাসাবাদে তারা নিজেদেরকে পরস্পরের প্রেমিক-প্রেমিকা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবী বলে জানিয়েছে। তারা আরো জানান, এই দুই প্রেমিক যুগল দীর্ঘদিন ধরে একই সাথে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ইয়াবা পাচার করে আসছেন। প্রত্যেকবার ইয়াবা পৌঁছে দেবার বিনিময়ে তারা জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে পান বলে জানান।