[ নিজস্ব প্রতিবেদক ]
রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে কক্সবাজার সদরের বিভিন্ন হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তৎপরতা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা মাসে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করে বলে খবর পাওয়া গেছে। আর এতে সরকার কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।
জানা গেছে, সদরের জনবহুল বাজার লিংকরোড়, বাংলাবাজার, খুরুশকুল, উপজেলা, পিএমখালী ও রামুর মিঠাছড়িতে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী নেতৃত্বের পাশাপাশি উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ব্যতিব্যস্ত রয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংকিংয়ে নানা হয়রানির অজুহাতে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশ থেকে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হুন্ডি। বিশেষত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় থাকা রোহিঙ্গাদের সামনে রেখে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে হুন্ডির মতো নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালান চক্রের এজেন্ট হিসেবে লিংকরোড়-বাংলাবাজারের বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট কক্সবাজারের এই হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালানের পাশাপাশি হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, সারা বছরেই হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসীদের টাকা দেশে আসে।
পিএমখালী এলাকার মেহেদী (ছদ্মনাম) দীর্ঘ দিন ধরে সৌদিতে থাকেন। তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান। সৌদিতে থাকা হুন্ডির এজেন্টদের কাছে টাকা জমা দিয়ে দেশে তার ছোট ভাই সুমনকে (ছদ্মনাম) ফোনে জানিয়ে দেন। প্রবাসী ভাইয়ের কাছ থেকে ফোন পাওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই রিয়াদের ফোনে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে বলা হয়, ভাই আপনার একটি চালান আছে? এপাশ থেকে সম্মতিসূচক জি বলতেই অপর প্রাপ্ত থেকে বলা হয়, কত? সুমন বলেন, এক ত্রিশ। অপর প্রান্ত থেকে নিশ্চিত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রিয়াদের দেয়া ঠিকানায় চলে আসে অপরিচিত ওই ব্যক্তি। এক হাজার টাকার বান্ডেল এবং আরো ৬০টি ৫০০ টাকার নোট দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন অপরিচিত ওই ব্যক্তি। কথোপকথনের এক ত্রিশ’ মানে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা।
এভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয় হুন্ডিতে। শুধু সৌদি প্রবাসী মেহেদী নন, প্রবাসীদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করা প্রবাসীদের বেশির ভাগই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রবাসীদের অভিযোগ, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে হয়রানির শিকার হতে হয়। কিন্তু হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর ঘণ্টার মধ্যেই ঘরে পৌঁছে যায়।
প্রবাসীদের এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লিংকরোড়-বাংলাবাজারের হুন্ডির কয়েকটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে কক্সবাজার শহর ও পিএমখালীর কয়েকটি সিন্ডিকেট।
জানা গেছে, কক্সবাজার সদরের পিএমখালী ও ঝিলংজা ইউনিয়নের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এদের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি লোক স্বজনদের কাছে টাকা পাঠানোর ভরসা রাখেন হুন্ডি ব্যবসায়ীদের ওপর। এসব মানুষের প্রতি মাসে টাকা লেনদেনের হার প্রায় ৫০ কোটি টাকারও বেশি বলে এক হিসাবে জানা গেছে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা তাদের টাকায় বিভিন্ন ব্যবসা করে বলে জানা গেছে। আবার কখনো কখনো হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের টাকার মাধ্যমে জাল টাকার নোটও ছড়িয়ে দেয়। এত করে নিরীহ মানুষ নানান দুর্ভোগের শিকার হন।
দীর্ঘকাল ধরে এ ব্যবসায় একশ্রেণীর হুন্ডি ব্যবসায়ীর পকেট ভারী হলেও কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। প্রশাসনিকভাবে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধে এ যাবৎকালে কোনো অভিযানও চোখে পড়েনি। ফলে একপ্রকার স্বাভবিকভাবেই এ কারবার পরিচালনা করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের কক্সবাজার শাখার ব্যবস্থাপক বলেন, এখন বিদেশ থেকে দেশে টাকা পাওয়া একেবারে সহজ হয়ে গেছে। তারপরও কিছু কিছু প্রবাসী হুন্ডির মাধ্যম টাকা পাঠাচ্ছে। এতে একদিকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে ঝুঁকি থাকে টাকা নিয়ে। আমরা প্রবাসী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের হুন্ডির মাধ্যমে টাকা না পাঠাতে অনুরোধ করে আসছি। ইতোমধ্যে অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছে।
এই ব্যাপারে সদর থানার ওসি (তদন্ত) খাইরজ্জামান জানান, হুন্ডি ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। তবে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ থানায় দেয়নি। অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।