-লেখক রাজিব আহমেদ
মহিলা সমাজে এখন এই ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, তেল ছাড়া রান্নাই করা যায় না! আচ্ছা ভাবুন তো সৃষ্টির শুরুর সময়টার কথা। পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) কোন তেলের রান্না খেতেন?!? বিবি হওয়া কি আদৌ রান্না করার সুযোগ পেয়েছিলেন? কেননা আগুন প্রজ্বলনের প্রচলন হয়েছে আরো অনেক পরে (যদিও আল্লাহ সুবহানুতায়ালা আদমকে সকল বিষয়ে জ্ঞানদান করেছিলেন)।
আচ্ছা থাক, সৃষ্টির শুরুর কথা না হয় বাদই দিলাম; আমাদের দাদী-নানীরা কোন ব্র্যান্ডের তেল দিয়ে রাঁধতেন? দেশ স্বাধীনের পরপর এদেশে বিদ্যমান চিনি, তেল ও লবণ সংকটের কথা যদি উহ্যও রাখি, বাস্তবতা হলো- গৃহকর্তাগণ সপ্তাহে একদিন তেলের ছোট্ট শিশি হাতে নিয়ে হাটে যেতেন; সেইটুকু তেলে ৮-১০ সদস্যের পুরো পরিবারের সারা সপ্তাহের রান্না হতো। অথচ এখন ৪-৫ জনের পরিবারে মাসে ৮/১০ লিটার তেল লাগে!
একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন- গণমাধ্যমে (টেলিভিশন ও পত্রিকায়) রান্নার অনুষ্ঠানগুলো স্পন্সর করে বিভিন্ন তেল উৎপাদন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো। রান্নার অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র সেইসব রেসিপি-ই দেখানো হয়, যেগুলো রাঁধতে তেল বেশি লাগে এবং রান্নাটা শুরুই হয় ফ্রাইপ্যান-এ তেল ঢালার মধ্য দিয়ে!
স্রেফ বাণিজ্যিক স্বার্থে তেলকে রান্নার প্রধান ও অপরিহার্য উপাদান হিসেবে পরিগণিত করানো হয়েছে। তেল ছাড়া নাকি তরকারিতে স্বাদ হয় না! কিন্তু আমরা কি জানি- রান্না করা খাবারে স্বাদের কৃতিত্ব আসলে তেল-এর নয়, মশলার। বিশ্বাস না হলে এক চামচ তেল মুখে ঢালুন তো! দেখুন- কেমন লাগে? নিশ্চয় আপনার গা গুলিয়ে উঠবে, বমি করে ফেলে দেবেন। যে তেল মুখে ঢাললে এমন অবস্থা হয়, সেই তেল রান্নায় ব্যবহার করলে স্বাদ বাড়ায় কেমনে?!?
স্পষ্ট জেনে রাখুন- স্বাদের জন্য তেলের কোনো ভূমিকা নেই। তেল বড়জোর চোখের ক্ষুধা মেটায়- মানে দেখতে চকচক করে, কিন্তু এর পুরোটাই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। রান্না করা খাবারে স্বাদ আসে বিভিন্ন প্রকার মশলা থেকে- যেগুলো নানাবিধ ঔষধি গুণে গুণান্বিত এবং শরীরের জন্য উপকারী। তাই তেল ছাড়া শুধু পানি দিয়ে বেশি পরিমাণে মশলার মিশ্রণে তরকারি রান্না করলে একদিকে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি কমবে, অন্যদিকে শরীর তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফিরে পাবে।
এ কথা সত্যি যে, আমাদের শরীরে কিছু ফ্যাট-এর প্রয়োজন আছে এবং তা আমরা প্রাকৃতিক বিভিন্ন খাবার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পেয়ে যাই। প্রযুক্তিগতভাবে উৎপাদিত উচ্চ ক্যালরিযুক্ত তেলের প্রভাবকে নিঃশেষ করতে যতখানি শারীরিক পরিশ্রম করা দরকার, আধুনিক জীবনযাপনে তা প্রায়ই করা হয়ে ওঠে না। ফলে এই তেল ক্যলরিতে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগই পায় না। উপরন্তু বেশি মাত্রায় তেল খেলে অতিরিক্ত ফ্যাট কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারিনরূপে হৃৎপিন্ডের ধমনীগুলোতে জমে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়- যেটাকে হার্টের ব্লকেজ বলা হয়।
শুধুমাত্র নির্বিচারে তেল খাওয়ার কারণে বিগত কয়েক বছরে হৃদরোগীর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বাস্তবতা হলো- বাংলাদেশে এখন যত নারীর হাতে (আঙুলে) রিং পরানো থাকে, তারচেয়ে অনেক বেশি পুরুষের হার্টে রিং পরানো আছে!
অনেকের ধারণা- একবার ব্লকেজ হয়ে গেলে তা আর অপসারণ/বিলোপ করা যায় না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, জীবনযাপনের ভুলগুলো শুধরে আদর্শ খাদ্যাভ্যাসে ফিরে এলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিই কমে না, বরং আগে থেকে জমে থাকা ব্লকেজও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। একইসঙ্গে ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাড় ক্ষয় ও গিঁটে বাত থেকেও রেহাই মিলতে পারে। এমনকি কিছুদিনের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তাই নিতান্ত প্রাণে বাঁচতে চাইলে এবং নিজের পরিবারকে সুস্থ তথা সুরক্ষিত রাখতে চাইলে কোনো অবস্থাতেই রান্নায় তেল ব্যবহার করা উচিত নয়।
ফ্যাট হচ্ছে শক্তির সঘন স্রোত। এর উৎস দু’টি – ১. প্রাণীজ আমিষ থেকে প্রাপ্ত কোলেস্টেরল এবং ২. উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ট্রাইগ্লিসারিন। কিছু ফ্যাট বেশি তাপমাত্রায় গলে যায় আর সাধারণ তাপমাত্রায় নিরেট অবস্থায় থাকে। আবার কিছু ফ্যাট ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় গললেও সাধারণ তাপমাত্রায় দ্রব অবস্থায় থাকে। ফ্যাট তিন রকমের হয়ে থাকে- স্যাচুরেটেড ফ্যাট, আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং বিশেষ ধরনের আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট।
ফ্যাট সহজে শরীর থেকে বের হতে চায় না। উল্টো বদহজমের সৃষ্টি করে। এক গ্রাম ফ্যাট-এ নয় ক্যালরি থাকে। সব রকমের ফ্যাট (মূলত তেলরূপে) রান্নার সময় খাবারে মিশে ট্রাইগ্লিসারাইডের স্তরকে বাড়িয়ে তোলে। যেসব খাবারে পুষ্ট ফ্যাট বেশি থাকে, সেগুলো স্থুলতা আর অপচনের সৃষ্টি করে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিযুক্ত পদার্থগুলোকে সহজে গ্রহণ করতে বাধার সৃষ্টি করে! স্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তের ঘনত্ব বাড়িয়ে তোলে; পরিণামে রক্ত জমে যেতে শুরু করে। হৃৎপিন্ডের ধমনীগুলো সংকুচিত হয়ে গেলে মানুষের অকাল মৃত্যু-ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।
তেল ছাড়া শুধু পানি দিয়েই সব রকমের রান্না করা সম্ভব। তবে এজন্য রাঁধুনীকে রান্নায় অধিক মনোযোগী হতে হবে। রান্নার সময় শুধু রান্নাই করতে হবে, অন্য কোনোদিকে মনোযোগ দেওয়া চলবে না। কেননা তরকারি যাতে লেগে/পুড়ে না যায়, সেজন্য ক্রমাগত নাড়তে হবে এবং একটু একটু করে পানি মেশাতে হবে। মশলার পরিমাণ সামান্য বাড়াতে হবে আর বাকি সব প্রক্রিয়া আগের মতোই বহাল থাকবে। তাহলেই তৈরি করা সম্ভব হবে তেল-বিহীন স্বাদযুক্ত মজাদার সব খাবার।
আমার বাসায় বিগত ছয় মাস ধরে তেল ছাড়া রান্নার অনুশীলন চলছে…! এমনকি রমজান মাসেও তেল-বিহীন ইফতারি তৈরি হয়েছে প্রত্যেকদিন। ছবিতে প্রদর্শিত খাবারগুলো সবই তেল ছাড়া রান্না করা; দেখেও বোঝার উপায় নেই, স্বাদেও কোনো কমতি নেই। আগে প্রতি মাসে আমার পরিবারে (তিনজন শিশূসহ মোট ছয়জন) ১০/১২ লিটার তেল লাগত; এখন সেখানে মাত্র এক লিটার তেল লাগে (এই তেলটুকু ব্যবহৃত হয় কালেভদ্রে)! শুভ সংবাদ হলো- বিগত ছয় মাসে আমার পরিবারে কোনো ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয়নি! শোকর আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সবাই খুব ভালো আছি; নিরাপদ জীবনযাপন করছি।
বিস্তারিত জানতে, বুঝতে ও শিখতে এবং বিনা তেলে রান্নার স্বাদ নিতে চাইলে আপনিও সপরিবারে (কাজের বুয়াসহ; নইলে সহসা পরিবর্তন হবে না) যোগ দিতে পারেন আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘আসুন সুস্থ থাকি’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালায়। পরবর্তী আয়োজনের দিন ধার্য্য করা হয়েছে ৩০ আগস্ট ২০১৯; শুক্রবার, গুলশান নিকেতনের ডি ব্লকে ১০/২নং সড়কে ব্র্যাক লার্নিং সেন্টার-এ। জনপ্রতি শুভেচ্ছা ফি ৯৯৯/- মাত্র। বুকিং দিতে যোগাযোগ করুন ০১৮১৭-১৮০১৮৮ নম্বরে। #