যুদ্ধে কক্সবাজারে প্রথম শহীদ হন মোঃ শরিফ চেয়ারম্যান। তিনি কক্সবাজারের মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। রাজাকাররা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২২এপ্রিল কক্সবাজার শহরের গেরেন্দ্র লাল চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায় পাক সেনারা। তিনি আর কখনো ফিরেননি। তার সন্তান এডভোকেট পিযুষ চৌধুরী জানান, অনেক খোঁজাখুঁজি ও অপেক্ষার পরও তার পিতার লাশের সন্ধান পাননি তারা।
১৯৭১ সালের ৬ মে। কক্সবাজারের ইতিহাসের এক স্মরণীয় দিন। দেশীয় পাক দোসরদের হাতে বন্দী ছাত্রনেতা সুভাস, ফরহাদসহ ৭/৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে টেনে হিচড়েঁ নিয়ে যাওয়া হয় বাঁকখালী নদীর তীরে। তারপর সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে খাঁঝরা করে দেয়া হয় সকলের বুক।
এসময় গুলি খেয়েও ফরহাদ বেঁচে যান। ব্রাশ ফায়ার করে হানাদার বাহিনী স্থান ত্যাগ করলে গুলিবৃদ্ধ ফরহাদ খুব কষ্টে সাঁতরিয়ে বাঁকখালী নদী পার হয়ে খুরুশকূলের কূলে উঠে। কাতরাতে কাতরাতে একটি পাহাড়ের মসজিদের পাশে এসে হুমড়ে পড়ে।এসময় জনৈক ব্যক্তি তাকেঁ উদ্ধার করে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দেয়।
কিন্তু ওঁৎপেতে থাকা পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে ফরহাদের শেষ রক্ষাও মেলেনি। আমির হামজা নামক জনৈক পাক দোসর শহরের হানাদার ঘাটিতেঁ খবর দিয়ে ফরহাদকে আবারো ধরিয়ে দেয়। তারা ফারহাদকে গুলি করে হত্যা করে।
কক্সবাজারে হানাদার বাহিনীর একাধিক হত্যাকাণ্ড স্বচক্ষে দেখেছেন দেলোয়ার হোসেন (৭০)। তিনি জানান,নদী ও সাগর তীরে নিয়ে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতো হানাদার বাহিনী। কখনো হত্যার পরও নদীতে লাশ ফেলে দিতে দেখেছেন তিনি।
কক্সবাজারের পুরাজেলার চিত্র ছিল একই। তবে দক্ষিণ চট্টগ্রামে একদিনে সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ হয় জেলার মহেশখালীতে। জাতীয় তথ্য বাতায়ন সূত্রে জানা যায়, কালারমারছড়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ শরিফ চেয়ারম্যান হত্যার পর অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকাররা। কক্সবাজারে অবস্থানরত পাকহানাদার বাহিনীকে সোপর্দ করা হয় এসব মুক্তিযোদ্ধাদের।
পরবর্তী মুক্তিবাহিনীর সদস্য তাদের সহযোগী ও সংখ্যালঘু অমুসলিমদের হত্যার উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ৬মে, ২০০ পাকহানাদার বাহিনীকে মহেশখালীতে নিয়ে আসে রাজাকাররা।পাক হানাদারদের সাথে যুক্ত হন আরো অন্তত ৪০০ জনের মত রাজাকার।
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাক হানাদার ও তাদের দোসরেরা মহেশখালী জুড়ে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠে। তারা এক এক করে হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ, ও মহেশখালী আদিনাথ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৭০০ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, অবলা ধর্ষিতা নাম না বলা ৩০০ নরনারী ও পাকহানাদারের গুলিবিদ্ধ ও অত্যাচার আঘাত প্রাপ্ত আরোও ২০ জন ভয়ানক নির্যাতনের ফলে কিছুদিন পর পর মৃত্যুর মূখে পতিত হয়। যা মহেশখালীর ইতিহাসে চিরদিন ভাস্কর চিত্র হয়ে থাকবে। এ কারনে জেলার সর্বমোট ২০টি বধ্যভূমির মধ্যে মহেশখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১০ টি বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধের স্বাক্ষী হয়ে আছে।
মহেশখালী থানাটি মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে বাহিরের অন্যকোন মুক্তিযোদ্ধা গিয়ে সাহায্য করতে পারেননি। তাই এই দ্বীপে মুক্তি সংগ্রামীদের উপর অভাবনীয় নির্যাতন করতে পেরেছে পাকহানাদার ও তাদের দোসর শান্তি কমিটির লোকজন। দক্ষিণ চট্টগ্রামে একদিন এতগুলো মানুষ হত্যা করার ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিরল।
১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রকল্প ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে,কক্সবাজার জেলার ১৯৫টি গণহত্যা, ২০টি বধ্যভূমি, ২৯টি গণকবর, ২৩টি নির্যাতন কেন্দ্রসহ ২৬৭টি গণহত্যা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানেরা বধ্যভূমি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বহন করে এমন সব কিছুই সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে। দাবির সাথে একমত পোষণ করেছেন জয় বাংলা বাহিনীর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ক্রীড়া সংগঠক মোহাম্মদ আলী।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, এরই মধ্যে একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা স্বাধীনতার স্মৃতি বিজড়িত সকল স্থান চিহ্নিত করে ছবি ভিডিও ধারণ করবে। আগামী প্রজন্ম যাতে ইতিহাস সহজে জানতে পারে এজন্য খুব শিগগিরই এসব সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।