নিউজ ডেস্ক :
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন ইস্যুতে শিক্ষা উপমন্ত্রীর বিরূপ মন্তব্য ও প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এছাড়াও তাদের ভবিষ্যত আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনে এক সংবাদ সম্মেলেন তারা আন্দোলন ও মন্ত্রীর বক্তব্যে সম্পর্কে কথা বলেন ও নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আন্দোলনকারী শহিদুল ইসলাম পাপ্পু বলেন,‘গত ৩ নভেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আন্দোলনরত শিক্ষক প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়। সেখানে মন্ত্রী ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও তথ্য তার কার্যালয়ে জমা দেবার জন্য ৮ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। এদিকে শিক্ষা উপমন্ত্রী শনিবার আমাদের বিরুদ্ধে কালক্ষেপণের যে অভিযোগ তুলেছে, আমরা মনে করি শিক্ষামন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় এই সময় বেঁধে দেয়ার বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষা উপমন্ত্রী অবগত ছিলেন না।’
তিনি আরো বলেন, শিক্ষা উপমন্ত্রীর বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, শিক্ষামন্ত্রী বরাবর যে তথ্য উপাত্ত আমরা উপস্থাপন করেছি, সেটি তিনি পড়ে দেখেননি। শিক্ষা উপমন্ত্রী পরিস্থিতি সম্পর্কে যথাযথ ভাবে অবহিত হলে তিনি এমন বক্তব্য দিতেন না। অন্যদিকে আন্দোলনে ছাত্রলীগের এই ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনাকে ‘গণঅভ্যুত্থান’ উল্লেখ করে করে তিনি ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মহান চেতনাকে কলঙ্কিত করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এছাড়াও ভিসি নিজেই সৃষ্টি করা এই অচলবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের মতামতের তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল ভ্যাকেন্ট ঘোষণা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শিক্ষা উপমন্ত্রী আমাদের দিকে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুড়েছেন। প্রথমেই তিনি প্রকল্পের অর্থ ছাড় না হওয়ার কথা বলেন। দুর্নীতি কেবল অর্থ ছাড়ের মাধ্যমেই ঘটতে পারে তা নয়। প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই গত ২৬ মে ইউনাইটেড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ভিসি বরাবর ছাত্রলীগ কর্তৃক টেন্ডারের শিডিউল ছিনতাইয়ের লিখিত অভিযোগ করে।
সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ই-টেন্ডার পদ্ধতির নিয়ম থাকলেও তিনি ম্যানুয়াল প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন, যা দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়। বিষয়টি আমাদের নজরে আসলে আমরা বিচার চাই। কিন্তু সেই অভিযোগের ব্যপারে আজ পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে আমাদের কাছে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তিনি নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন।
এদিকে দুর্নীতির টাকা পাওয়ার ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দেয়া দুই ছাত্রলীগ নেতার জবানে এই ব্যাপারে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এমনকি তারা নির্দিষ্ট তারিখে ভিসি, তার স্বামী, ছেলের কল রেকর্ড ঘেটে দেখলে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে দাবি করেন।
তারা আরো বলেন, আমরা মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেগাপ্রজেক্টকেন্দ্রিক কোন রকম দুর্নীতির আভাস পেলেই একজন ভিসির উচিত তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু তিনি তা না করে উল্টো টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়ার দায়িত্ব নেন বলে জানা যায়। এ থেকে প্রমাণিত হয় মেগাপ্রজেক্ট কেন্দ্রীক দুর্নীতির সাথে ভিসি ও তার পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদিও শিক্ষা উপমন্ত্রী তদন্তের ব্যাপারে সদিচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তবে তার বক্তব্যে টাকা ছাড় না হওয়ায় দুর্নীতি হয়নি, এমন যে দাবি করেছেন তা আসলে তদন্তের পূর্বেই তদন্তের ফলাফল বলে দেয়ার নামান্তর। আমরা তাই নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করছি।
এদিকে শিক্ষা উপমন্ত্রী গত ৭ নভেম্বর ভিসির বাসভবনের সামনে হওয়া প্রতিবাদী কনসার্টের অর্থ যোগান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা তাকে জানাতে চাই, ওই কনসার্টে আমরা কোন ধরণের সাউন্ড সিস্টেম পর্যন্ত ব্যবহার করিনি। শিল্পীরা মাত্র একটি হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করে গান গেয়েছেন এবং আন্দলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে তারা কোন পারিশ্রমিকও নেয়নি। তাই কনসার্ট কেন্দ্রিক ব্যাপক অর্থ খরচের প্রশ্ন আসে না। আমরা আন্দোলনকারীদের কাছ থেকেই গণচাদা উত্তোলনের মাধ্যমেই প্রতিটি কর্মসূচি সফল করে এসেছি।
এর আগে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো ত্রুটিপূর্ণ একটি মাস্টারপ্লান পুনর্বিন্যাস করা ও ৫ তলা বিশিষ্ট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলকে ঘিরে তিন পাশে তিনটি ১০ তলা হল নির্মাণ না করে তা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবিতে। আন্দোলনের মুখে প্রশাসন মাস্টারপ্লান দেখানোর নামে নামমাত্র একটি এনিমিটেড ভিডিও ক্লিপ দেখায় এবং সেই সভায় দেশবরেণ্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মাস্টারপ্লানের কাজ ৩ মাস স্থগিত রেখে প্লানটি নতুন করে আবার কাজ শুরু করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ভিসি সেই প্রস্তাবটিও প্রত্যাখ্যান করে সভা শেষ করেন।
এরপর থেকে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী চালিয়ে আসছিলাম। পরবর্তীতে গণমাধ্যমে আসা দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্দোলনের মুখে প্রথম দফায় মাস্টারপ্লান পুনর্বিন্যস্ত করা ও হল সরানোর দাবি মেনে নিলেও দুর্নীতির তদন্তের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করলেও করণীয় ঠিক করতে তিন কার্যদিবস সময় নেন। তাকে সম্মান জানিয়ে দ্বিতীয় দফা আলোচনার পূর্বে আন্দোলন স্থগিত ছিলো। নির্ধারিত দিনে বৈঠকের আগেই দুই দফা আলোচনার মধ্যবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাতকারে ভিসি গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানান। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে চাদা দাবি করার অভিযোগ করেন এবং এর প্রেক্ষিতে তারা ভিসি ও তার ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে।
এরই মধ্যে শাখা ছাত্রলীগের তিন নেতা টিভি ক্যামেরার সামনে ভিসির বাসভবনে তার স্বামী-সন্তানের উপস্থিতিতে টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা হবার ও পরবর্তীতে টাকা পাওয়ার ঘটনার স্বীকারোক্তি প্রদান করেন। নির্ধারিত বৈঠকের দ্বিতীয় দফায় আমরা এ বিষয়ে ভিসির কাছে যৌক্তিক ব্যাখ্যা আশা করলেও তিনি উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। একই সাথে তদন্তের ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট উদ্যোগ নেয়ার দাবিকে নাকচ করে দেন।
এর প্রেক্ষিতে নৈতিক স্খলন ও অর্থ কেলেংকারির অভিযোগের উত্তর দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ভিসিকে সসম্মানে পদত্যাগ করার আহ্বান জানাই আমরা। পরবর্তীতে নির্ধারিত সময়ে পদত্যাগের আহ্বানে সাড়া না দেয়ায় স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান রাষ্ট্রপতিকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাই। আন্দোলন চলাকালীন সময়েও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে সচেতন ছিলাম বলেই ভর্তি পরীক্ষাকে বাধাগ্রস্থ না করে বরং ভর্তিচ্ছুদের সহায়তা প্রদান করি। আমরা আশা করেছিলাম দেশের গ্রহণযোগ্য ও প্রথম সারির গণমাধ্যমে দুর্নীতির অভিযোগ ফলাও করে প্রচার করার পর সরকার উদ্যোগী হয়ে বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম যে, শিক্ষা উপমন্ত্রী তদন্তের প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাহ্য করে গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদান করেন। এর ফলে আন্দোলনে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিলো না। এবং তার প্রেক্ষিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি বর্তমানে পুরো দেশবাসীর নজরে এসেছে এবং সরকার তদন্তের উদ্যোগ নিতে সম্মত হয়েছে।
আমরা বলতে চাই, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগ চাইনি বরং উন্নয়ন পরিকল্পনার দুর্নীতির তদন্তের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসন এবং সরকারের নির্লিপ্ততা বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে।
আমরা কোন ধরনের অরাজতকতা, সহিংসতা ও বিশৃংখলা এড়িয়ে শৈল্পিকভাবে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছি। কিন্তিু ভিসির নির্দেশে ছাত্রলীগের একাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরী করে। আমরা আশা করেছিলাম শিক্ষা উপমন্ত্রী ছাত্রলীগের ভয়াবহ আক্রমণের নিন্দা জানাবেন, কিন্তু তিনি উলটো আমাদেরকেই অরাজকতা সৃষ্টিকারী বলে অভিহিত করেছেন। তার এই বক্তব্যে আমরা মর্মাহত।
আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের আন্দোলন ন্যায্য ও যৌক্তিক এবং সরকার আমাদের এই ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবাজ ভিসিকে অপসারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে। সেই সাথে অবিলম্বে হল ভ্যাকেন্টের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির অবসান ঘটানোর জোর দাবি জানাই। আমরা বিশ্বাস করি, তদন্তের পূর্বেই কোন পক্ষের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য না করে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হলে ভিসি দোষী প্রমাণিত হবে।
এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে তদন্তের সময় ভিসিকে ছুটিতে রেখে নিরপেক্ষ তদন্ত করার কথা বলা হয়। এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর কারণে রোববার ও সোমবার আন্দোলনে বিরতি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এরপর মঙ্গলবার থেকে আবার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।